সিলেট নগর
টিলা কাটা মাটিতে প্রশস্ত হচ্ছে নগরের রাস্তা
স্থানীয় কাউন্সিলর ও ছাত্রলীগের এক নেতার বিরুদ্ধে এই কাজে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
সিলেট নগরের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের নূরপুর রাস্তাটি প্রশস্ত করছে সিটি করপোরেশন। রাস্তা প্রশস্ত করতে টিলা কেটে মাটি এনে ফাঁকা অংশ ভরাট করা হচ্ছে। স্থানীয় লোকজন বলছেন, নির্মাণাধীন রাস্তার অন্তত এক কিলোমিটার দূরে ফাল্গুনী এলাকার তিনটি ব্যক্তিমালিকানাধীন টিলা কেটে মাটি এনে এখানে ফেলা হচ্ছে। এ কাজে স্থানীয় কাউন্সিলর ও ছাত্রলীগ নেতা মো. রুহেল আহমদ নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
যোগাযোগ করলে সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের জানা নেই। এমনটা হলে অবশ্যই আপত্তিকর। বিষয়টি স্থানীয় কাউন্সিলরের সঙ্গে আলাপ করব।’
গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা গেছে, মেজরটিলা বাজার পেরিয়েই সিলেট-তামাবিল আঞ্চলিক মহাসড়ক-লাগোয়া ঠিক ডান দিকে নূরপুর এলাকার রাস্তাটি চলে গেছে। রাস্তার একাংশ আরসিসি পাকা করা আছে। বাঁ দিকের বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) আঞ্চলিক বীজ গুদাম-২-এর মালিকানাধীন কৃষিজমির জায়গায় পাকা বেষ্টনী দিয়ে রাস্তাটি প্রশস্ত করা হচ্ছে। প্রশস্তকৃত রাস্তার অংশটি কৃষিজমি হওয়ায় অনেকটা গভীর। এ অংশ ভরাট করতে স্থানে স্থানে ফেলা হয়েছে টিলা থেকে কেটে আনা মাটি। গতকাল মাটি ফেলার কাজ না হলেও রাস্তার পাশের নর্দমা ও বেষ্টনী নির্মাণে ২০ থেকে ২৫ জন শ্রমিককে কাজ করতে দেখা গেছে।
স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেশ কিছুদিন ধরে রাস্তাটির প্রশস্তকৃত অংশে মাটি ফেলা হচ্ছে। পাশের ফাল্গুনী এলাকার তিনটি মালিকানাধীন টিলার মাটি কেটে এনে এখানে ফেলা হচ্ছে। তবে পাশের চামেলীবাগ এলাকায় টিলাধসে গত সোমবার সকালে একই পরিবারের তিনজন নিহত হওয়ার পর রাস্তায় মাটি ফেলার কাজ আপাতত বন্ধ আছে।
গতকাল বিকেলের দিকে নূরপুর রাস্তায় গেলে এক ব্যক্তিকে শ্রমিকদের নালা নির্মাণের কাজ তদারকি করতে দেখা যায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুনেছি, টিলার কিছু মাটি এখানে (রাস্তার সম্প্রসারিত অংশ) ফেলা হইছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মেজরটিলা এলাকার একজন বাসিন্দা বলেন, ‘মূলত ব্যক্তিমালিকানাধীন টিলাগুলো কেটে সমতল ভূমি করার জন্য মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে অলিখিত চুক্তি নেন স্থানীয় কাউন্সিলর রুহেল আহমদের নেতৃত্বে কয়েকজন। এরই অংশ হিসেবে তিনটি টিলা থেকে মাটি কেটে সিটি করপোরেশনেরই ট্রাকে করে রাস্তার পাশে এনে ফেলা হচ্ছে।’
স্থানীয় কাউন্সিলর রুহেল আহমদ সিলেট সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি। তিনি টিলার মাটি কেটে রাস্তা প্রশস্ত করার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। রুহেল আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে টিলার মাটি ফেলার বিষয়টি ঠিক নয়। আমি কোনো টিলা কাটার সঙ্গে জড়িত নই। এ ছাড়া রাস্তা প্রশস্তকরণে মাটি ফেলার কাজ করছেন অপর একজন ঠিকাদার।’
রুহেল রাস্তা প্রশস্তকরণে মাটি ফেলার কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন জানালেও সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখার একটি সূত্র জানিয়েছে, নূরপুর রাস্তাটি প্রশস্তকরণ অংশে মাটি ফেলার জন্য এখনো কোনো দরপত্রই আহ্বান করা হয়নি। তবে রাস্তার গভীর অংশ ভরাটের জন্য মাটি ফেলাবাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৭০ লাখ টাকা। জনগুরুত্বপূর্ণ রাস্তা হওয়ায় স্থানীয় কাউন্সিলরের তদারকিতে দরপত্র আহ্বানের আগেই প্রশস্তকৃত অংশে মাটি ভরাটের কাজ চলছে। শিগগির দরপত্র আহ্বান করে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হবে। যে ঠিকাদার কাজ পাবেন, তিনি স্থানীয় কাউন্সিলরের সঙ্গে শেষ হওয়া কাজের ব্যয় সমন্বয় করবেন।
ফাল্গুনী এলাকার যে তিনটি ব্যক্তিমালিকানাধীন টিলার মাটি কাটা হচ্ছে, গতকাল বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা গেছে তিনটিই সুউচ্চ টিলা। কয়েক শ গজের মধ্যে এসব টিলার অবস্থান। টিলার বেশির ভাগ অংশ কেটে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলা হয়েছে। গত কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টিতে টিলার কেটে ফেলা অংশের মাটি নরম হওয়ায় গড়িয়ে পাশের রাস্তা ও বাসাবাড়িতে চলে এসেছে। এসব টিলার আশপাশে ঝুঁকি নিয়ে অনেক পরিবার বসবাস করছে। টিলাধসে যেকোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনার আশঙ্কা আছে।
এই তিনটি টিলার মালিকদের একজন তরিক উদ্দিন। টিলার মাটি নিয়ে নূরপুর রাস্তায় ফেলা হচ্ছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তরিক উদ্দিন বলেন, ‘মাঝে নিছইন (নেওয়া হয়েছে)। টিলা ভেঙে মাটি পড়েছিল। রাস্তা থেকে মাটি কিছু নিছইন।’
সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখা জানিয়েছে, নূরপুর রাস্তা নির্মাণ ও নর্দমা নির্মাণে দুটি প্রকল্পে কাজ হচ্ছে। রাস্তাটি আরসিসি পাকাকরণে ১ কোটি ৯২ লাখ টাকার কাজ চলছে। অন্যদিকে নর্দমা প্রশস্তকরণ ও নির্মাণে ১ কোটি ৮৮ লাখ টাকার কাজ হচ্ছে। বর্তমানে রাস্তাটি ৮৯০ মিটার লম্বা ও ১৫ ফুট চওড়া আছে। এখন রাস্তাটি ৪০ ফুট চওড়া করা হবে। রাস্তার বর্ধিত অংশে মাটি ভরাটে ৭০ লাখ টাকার একটি প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান করা হবে। মাটি ভরাট শেষেই প্রশস্তকৃত অংশে আরসিসি রাস্তা নির্মাণে পৃথক প্রকল্প নেওয়া হবে।
একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রশস্তকরণের অংশ হিসেবে রাস্তার উভয় অংশের জায়গা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বাঁ দিকের অন্তত ২০ ফুট অংশ বিএডিসির আঞ্চলিক বীজ গুদাম-২-এর মালিকানাধীন কৃষিজমির জায়গা নেওয়া হয়েছে। বাকি অংশগুলো ব্যক্তিমালিকানাধীন। বিএডিসির কাছ থেকে নেওয়া অংশেই এখন মাটি ভরাটের কাজ চলছে।
টিলা কেটে সিটি করপোরেশনের রাস্তা ভরাট প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী (কিম) প্রথম আলোকে বলেন, এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ এবং জনপ্রতিনিধিরা যেখানে টিলা সংরক্ষণে ভূমিকা রাখার কথা, সেখানে তাঁরা টিলা কেটে ধ্বংস করছেন। অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।