রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অছাত্ররা’ ছাত্রলীগের নেতা হওয়ার সুবাদে আবাসিক হলের একাধিক আসন দখল করে থাকছেন। আর আসন বরাদ্দ পেয়েও অনেক সাধারণ ছাত্র হলে উঠতে পারছেন না। শুধু শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলেই ছাত্রলীগের দখলে আছে শতাধিক আসন। প্রশাসন তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্র নন, তবু হলে থাকছেন—এমন ছাত্রলীগ নেতাদের কোনো সুনির্দিষ্ট হিসাব পাওয়া যায়নি। গত বছরের অক্টোবরে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ৩৯ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটির অন্তত ৯ জন ‘অছাত্র’ নেতা হলে দাপটের সঙ্গে অবস্থান করছেন বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। এ তালিকায় আছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান (বাবু) ও সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিব, ছয়জন সহসভাপতি ও একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এ ছাড়া সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের অনুসারী হল কমিটি ও গত কমিটিরও কয়েকজন অছাত্র হলে থাকছেন। আসাদুল্লা-হিল-গালিব ও তাঁর অনুসারী সাংগঠনিক সম্পাদক জাহিদ হাসান একই সঙ্গে দুটি হলে চার আসনের দুটি করে কক্ষ দখলে রেখেছেন। ছাত্রলীগের এ কমিটি হওয়ার পর দুই শীর্ষ নেতার সঙ্গে হল পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে আস্তানা গেড়েছেন, এমন নেতাও রয়েছেন।
জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকেরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিকতার সংকট আছে। অনেক গরিব, মেধাবী ছাত্র হলে আসন পাচ্ছেন না। অথচ ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একপ্রকার গা ছাড়া ভাব পরিলক্ষিত হয়। অনেক ক্ষেত্রেই প্রশাসনের অসহায় ভূমিকা দেখা যায়, যা মোটেই কাম্য নয়।
একাডেমিক শাখা সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৬ হাজারের বেশি নিয়মিত শিক্ষার্থী আছেন। এর মধ্যে ছাত্র ১৬ হাজার ৯৬৯ জন। ছাত্রদের ১১টি আবাসিক হলে মোট আসন ৫ হাজার ৩৮৩টি, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। ফলে বেশির ভাগ ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয়–সংলগ্ন মেসে থাকতে হয়। ছাত্রদের হলগুলোয় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের দাপট রয়েছে। আসন দখল, শিক্ষার্থীকে নামিয়ে দেওয়াসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে।
এক হলেই শতাধিক আসন দখল
সোহরাওয়ার্দী হলে শতাধিক আসন কাগজে-কলমে খালি আছে। তবে বাস্তবে সেগুলো ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা দখলে রেখেছেন। এ জন্য শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত আসনে তুলে দিতে পারছে না হল প্রশাসন। হলের প্রাধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘হলের অনাবাসিক ও অছাত্রদের হল ত্যাগ করতে ১৬ মে পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা নামেননি। বেশ কিছু সাধারণ শিক্ষার্থীকে কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হলেও আসন খালি না থাকায় তাঁদের আসন দিতে পারছি না। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এসব আসন দখল করে আছেন।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অন্যান্য হলেও কমবেশি একই অবস্থা। এ নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ থাকলেও তাঁরা মুখে কিছু বলতে পারছেন না। ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ শাহ মখদুল হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। তাঁকে ১৩৫ নম্বর কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি ওই কক্ষে উঠতে পারছেন না। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক ছাত্রলীগ নেতা আমাকে বরাদ্দ দেওয়া আসন দখল করে আছেন। আমি কক্ষে উঠতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি এক ছাত্রলীগ নেতার নাম বলে আমাকে উঠতে দেননি।’
অছাত্র হয়েও থাকছেন হলে
বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদার বখ্শ হলের প্রথম তলার সিঁড়ির দেয়ালে চোখ বোলাতেই দেখা যায়, ‘সেক্রেটারি ব্লক’ লেখা। চারটি কক্ষের দরজার ওপরে লাল রং দিয়ে বড় করে নামফলক দেওয়া। ২১৫ নম্বর কক্ষের ওপর লেখা—‘মো. আসাদুল্লা-হিল-গালিব, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়’। কক্ষটি চার আসনবিশিষ্ট। তিনি একাই এই কক্ষে থাকতেন। তবে সাধারণ সম্পাদক পদ পাওয়ার পর তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ২২৮ নম্বর কক্ষে থাকেন। সেই কক্ষও চারটি আসনবিশিষ্ট। মাদার বখ্শ হলের কক্ষটিতে মাঝেমধ্যে এক রাতের জন্য এসে থাকেন। এ হলে আসার সময় নেতা-কর্মীদের পক্ষ থেকে তাঁকে ‘লালগালিচা সংবর্ধনা’ দেওয়া হয়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন আসাদুল্লা-হিল-গালিব। প্রথম বর্ষে উত্তীর্ণ হলেও দ্বিতীয় বর্ষ আর টপকাতে পারেননি। পরে ছাত্রত্ব হারিয়েছেন। ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভুয়া সনদে’ তিনি বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সান্ধ্য কোর্সে ভর্তি হয়েছেন।
আরেক শীর্ষ নেতা সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বঙ্গবন্ধু হলের চার আসনবিশিষ্ট ২৩০ নম্বর কক্ষে একাই থাকেন। মোস্তাফিজুর গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। স্নাতকোত্তর শেষে ছাত্রত্ব ধরে রাখতে তিনি ইনস্টিটিউট অব ইংলিশ অ্যান্ড আদার ল্যাঙ্গুয়েজের একটি শর্ট কোর্সে ভর্তি হয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক শাখা সূত্রে জানা যায়, সান্ধ্য কোর্স ও শর্ট কোর্সে ভর্তি হওয়া ব্যক্তিদের নিয়মিত শিক্ষার্থী বলার সুযোগ নেই। তাঁরা আবাসিক হল ও পরিবহনসুবিধা নিতে পারেন না।
মাদার বখ্শ হলের ২১৪ নম্বর কক্ষের দরজার ওপর সাধারণ সম্পাদক গালিবের অনুসারী শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহিদ হাসানের নামফলক রয়েছে। সেটিও চার আসনবিশিষ্ট। তবে তিনি বর্তমানে বঙ্গবন্ধু হলের চার আসনবিশিষ্ট একটি কক্ষে থাকেন। সেই কক্ষে আরেক ছাত্রলীগ নেতা থাকেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মনু মোহন বাপ্পা শাহ মখ্দুম হলের দুই আসনের ১২৯ নম্বর কক্ষ দখল করে একাই থাকেন। ছাত্রত্ব না থাকা সত্ত্বেও বর্তমান কমিটির সহসভাপতি শাহিনুল ইসলাম সরকার, মেজবাহুল ইসলাম, তাওহীদুল ইসলাম, তামান্না আক্তার, আবুল বাশার আহমেদ ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাদেকুল ইসলাম বিভিন্ন হলে কক্ষ দখল করে অবস্থান করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের গত কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফ করিম (রুপম), ক্রীড়াবিষয়ক উপসম্পাদক রূপক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের সহসভাপতি মাজহারুল ইসলাম, নবাব আবদুল লতিফ হলের সহসভাপতি তাসকিফ আল তৌহিদসহ আরও অনেক নেতা অছাত্র হয়েও হলে থাকছেন।
কোনো অছাত্র হলের রুম বা সিট দখল করে আছেন, এমন তথ্য জানা নেই বলে দাবি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমানের। তিনি বলেন, ‘হলের সব সিট রানিং (নিয়মিত) ছাত্রদের নামে বরাদ্দ। বরাদ্দ পাওয়া ছাত্ররা হয়তো তাঁদের রুমে কোনো বড় ভাইকে রেখেছেন, এমন হতে পারে। আর কমিটির যাঁদের কথা বলছেন, তাঁরা অনেকেই আর ক্যাম্পাসে নেই। তাঁদের হলের সিটগুলোয় বৈধ শিক্ষার্থীরাই রয়েছেন।’ কোথাও কোনো বিচ্যুতি ঘটে থাকলে হল প্রাধ্যক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন তিনি।
নেতা হলেই হল পরিবর্তন
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান আগে সৈয়দ আমীর আলী হলে থাকতেন। অছাত্র হওয়ায় হল প্রাধ্যক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের গত কমিটির সভাপতি গোলাম কিবরিয়ার অনুসারীরা তাঁকে হল থেকে বের করে দেন। গত অক্টোবরে ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার আগে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন। সভাপতি মনোনীত হওয়ার পর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর হলের চার আসনবিশিষ্ট একটি কক্ষে একাই থাকছেন। এর আগেও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারা বঙ্গবন্ধু হলে কক্ষ দখল করে থাকতেন।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কমিটি হওয়ার পর বেশ কিছু নেতা-কর্মী নিজের হল ছেড়ে অন্য হলে আশ্রয় নিয়েছেন। এমন হল বদলের তালিকায় বর্তমান ও গত কমিটির অন্তত এক ডজন নেতা-কর্মী আছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন হলেন সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিব, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহা ও সাদেকুল ইসলাম, সাংগঠনিক সম্পাদক জাহিদ হাসান, হবিবুর রহমান হলের সহসভাপতি ইসলাইল হোসেন প্রমুখ। তাঁদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকি সবাই বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে থাকেন।
প্রশাসনের গা ছাড়া ভাব
আবাসিক হলে অবস্থানকারী অছাত্রদের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা হল প্রশাসনের কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি। শিক্ষার্থী নির্যাতনের অভিযোগে হল থেকে সাময়িক বহিষ্কৃত হলেও দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতার পদ নিয়ে আবার হলে ফিরেছেন নবাব আবদুল লতিফ হল ছাত্রলীগের সহসভাপতি তাসকিফ আল তৌহিদ। গত এক বছরে কয়েকটি হলে অনাবাসিক ও অছাত্রদের হল ত্যাগের নোটিশ দিলেও কেউই হল ত্যাগ করেননি। আবাসিকতার ক্ষেত্রে মেধাবী, অসহায় ও গরিব ছাত্রদের প্রাধান্য দেওয়ার কথা থাকলেও তাঁরাই সবচেয়ে বেশি অসহায়। ছাত্রলীগের তদবির ছাড়া হলে আসন মেলে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে এক ছাত্রলীগ কর্মী বলেন, ‘হল প্রশাসনের মাধ্যমে হলে ওঠার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা বলেন, “আপনি ফাঁকা সিট খুঁজে বের করেন।” যেহেতু পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, তাই এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে রাজনীতি করার শর্তে হলে উঠেছি।’
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তারকে পাওয়া যায়নি। সহ-উপাচার্য সুলতান-উল-ইসলাম হলে আসন দখলে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, যেহেতু সমস্যাগুলো আবার দেখা দিয়েছে, এ বিষয়ে হল প্রশাসনকে তথ্য দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। তাদের বলা হয়েছে, তারা যতটুকু পারবে গুছিয়ে নেবে। এ মুহূর্তে উপাচার্য বাইরে রয়েছেন, তিনি এলেই বিষয়গুলো নিয়ে হল প্রশাসনের সঙ্গে বসা হবে। কীভাবে সুরাহা করা যায়, সে চেষ্টা করা হবে।