সীমান্তের ওপারে বিস্ফোরণের ধাক্কায় টেকনাফের ঘরবাড়িতে ফাটল

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুতে মর্টার শেলের বিস্ফোরণে ধাক্কায় ফাটল ধরেছে টেকনাফের সীমান্তবর্তী গ্রামের এই ঘরটিতে। টেকনাফ সদর ইউনিয়নের মৌলভিপাড়ায় গতকাল বিকালেছবি: প্রথম আলো

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) লড়াই আরও তীব্র হয়েছে। তিন দিন ধরে মর্টার শেলের গোলাবর্ষণের পাশাপাশি যুদ্ধবিমান থেকেও বোমা ফেলা হচ্ছে। সীমান্তের ওপারে একটানা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের ধাক্কায় টেকনাফের বেশ কয়েকটি ঘরবাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে। দেয়ালধসের আশঙ্কায় সেসব বাড়ির বাসিন্দারা প্রতিবেশী ও স্বজনদের বাড়িতে গিয়ে থাকছেন। কেউ রাত কাটাচ্ছেন খোলা আকাশের নিচে।

এক গ্রামেই ২৫ বাড়িতে ফাটল

মিয়ানমারের মংডু টাউনশিপের বিপরীতে সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের অবস্থান। মধ্যখানে চার কিলোমিটার প্রস্থের নাফ নদী। আজ বুধবার সকালে ওই ইউনিয়নের আছারবুনিয়া গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক। তখনো ওপারের বিস্ফোরণ শোনা যাচ্ছিল। ঘরের বাইরে এসে গাছের নিচে, দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে রাখাইন যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত মানুষজন। তাঁদের কাছ থেকে জানা গেল, সোমবার রাতে ১৫০টি মতো মর্টার শেলের বিস্ফোরণ শব্দ শুনেছেন তাঁরা। গতকাল মঙ্গলবার রাতে কমপক্ষে ২০০টি বিস্ফোরণ হয়। আজ সকাল ১০টা পর্যন্ত ১৫টি বিকট শব্দের বিস্ফোরণ শুনতে পান লোকজন। সঙ্গে যুদ্ধবিমান ও আকাশ থেকে বোমা ফেলেছে।

গ্রামের কয়েকজন বলেন, ওপারের বিস্ফোরণের ধাক্কায় আছারবনিয়া গ্রামের অন্তত ২৫টি ঘরের দেওয়ালে ফাটল ধরেছে। যেকোনো সময় সেসব ঘরের দেয়ালধসে প্রাণহানি ঘটতে পারে।

আছারবনিয়া গ্রামের মধ্যভাগে পানচাষি আলী আহমদের টিনের মাটির ঘর। গত রাতের ভূকম্পনের ঘরের এক পাশের দেয়াল ভেঙে বাইরের দিকে হেলে পড়েছে। এরপর চার ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘরের বাইরে গাছের নিচে অবস্থান নেন তিনি। আলী আহমদের স্ত্রী মাহমুদা বেগম (৪৬) বলেন, চার মাসের বেশি সময় ধরে ওপারের বিস্ফোরণের শব্দ শুনে আসছেন তাঁরা। মাঝেমধ্যে ওপারের গুলি এসে এপারের ঘরবাড়িতে পড়ছে। বিকট শব্দে ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফাটল বড়ে দেয়ালধসে প্রাণহানি ঘটতে পারে, এমন আশঙ্কায় ঘরের বাইরে রাত কাটাচ্ছেন তাঁরা। ঘর মেরামতের সামর্থ্যও তাঁদের নাই।

গ্রামে কথা হয় মোহাম্মদ হানিফের সঙ্গে। তিনি বেসরকারি ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে আছেন। হানিফ (৪৫) বলেন, ‘সারা দিন ব্যাংকের কাজে ব্যস্ত থাকি। রাতে ঘরে এসে ঘুমানো যায় না। ওপারের বিকট শব্দে ঘরবাড়ি কাঁপে। এখানকার অনেক ঘরে ফাটল ধরেছে। দেয়ালধসের আশঙ্কায় গ্রামের অনেক মানুষ গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র আত্মীয়স্বজনের বাসাবাড়িতে চলে যাচ্ছেন। এক গ্রামেই ২০-২৫টি বাড়িতে ফাটল ধরেছে।’

নির্ঘুম রাত ২৫ গ্রামের মানুষের

ওপারে মর্টার শেলের বিস্ফোরণে কাঁপছে টেকনাফের তিনটি ইউনিয়নের অন্তত ২৫টি গ্রাম। টেকনাফ সদর ইউনিয়নের নাইট্যংপাড়া, কায়ুকখালীয়াপাড়া, চৌধুরীপাড়া, জালিয়াপাড়া, কুলালপাড়া, শীলবনিয়াপাড়া, খানকার ডেইল, ডেইলপাড়া, নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, সাবরাংয়ের মগপাড়া, পানছড়িপাড়া, আছারবনিয়া, লেজিরপাড়া, ডেগিল্ল্যাবিল, ঝিনাপাড়া, শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়া, ক্যাম্পপাড়া, বাজারপাড়া ও মিস্ত্রিপাড়া এলাকা ঘুরে লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক দেখা গেছে। অনবরত গোলাগুলির বিকট শব্দে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন গ্রামের বাসিন্দারা।

ওপারের বিস্ফোরণে টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নসহ কয়েকটি গ্রামে লোকজনের ঘরবাড়িতে ফাটল ধরছে জানিয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আতঙ্কে সীমান্তবতী গ্রামের মানুষজন নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। তাঁদের নিরাপদ দূরত্বে থাকতে বলা হচ্ছে। রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফনদী ও সীমান্তে বিজিবি ও কোস্টগার্ড সতর্ক আছে।

ইউএনও বলেন, বসতবাড়ি ক্ষতিগ্রস্তের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে সরকারি সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে।