যাত্রী তোলা নিয়ে সেলফি বাসের রেষারেষিতে প্রাণ যায় শাহেরাদের

ঢাকার গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া রুটে প্রতিদিন দেড় শতাধিক সেলফি পরিবহনের বাস চলাচল করেছবি: প্রথম আলো

ভূমিহীন শফিকুল ইসলাম ও নুরজাহান বেগমের দুই সন্তানের মধ্যে ছোট ছিল শাহেরা আক্তার ওরফে শিলা (১৬)। সে ঢাকার মোহাম্মদপুরের জান্নাতুল ফেরদাউস মহিলা মাদ্রাসায় পড়ছিল। গত শনিবার ঢাকার আশুলিয়া থেকে মামার সঙ্গে মোটরসাইকেলে করে মোহাম্মদপুরের মাদ্রাসায় যাওয়ার পথে সেলফি পরিবহনের দুটি বাসের রেষারেষিতে সড়কে প্রাণ হারায় শাহেরা।

শাহেরাদের গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার শিবরামপুর গ্রামে। গতকাল রোববার সকালে তাকে সেখানেই দাফন করা হয়েছে। ঢাকায় তার পড়ালেখার ব্যবস্থা করেছিলেন মামা বরকত আলী। তিনিই মোটরসাইকেলে করে শাহেরাকে ঢাকায় মাদ্রাসায় পৌঁছে দিচ্ছিলেন।

বরকত আলী গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশুলিয়ার রপ্তানি এলাকা থেকে ঢাকার মোহাম্মদপুরে মাদ্রাসায় যাচ্ছিলাম আমার মেয়ে সুমাইয়া ও ভাগনিকে নিয়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ডেইরি গেটে সেলফি পরিবহনের একটা বাস ব্রেক করে যাত্রী তুলছিল। আমি ওই বাসের পেছনে ছিলাম। বাইকের গতিও খুব কম ছিল। হঠাৎ করে পেছন থেকে সেলফি পরিবহনের আরেকটি বাস এসে আমাদের বাঁয়ে ঢুকিয়ে আমাদের ধাক্কা দিলে পড়ে যাই আমরা। আমার ভাগনি গুরুতর আহত হয়। তাকে প্রথমে সাভারের সুপার মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যাই, সেখানে তারা ভর্তি নেয়নি। এরপর এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিই। এর মধ্যেই ভাগনি মারা যায়। একটা বাস কীভাবে আমাদের বাঁয়ে ঢুকে যেতে পারে কোনোভাবেই বুঝতে পারছি না আমি।’

আরও পড়ুন

যাত্রী ধরতে রেষারেষি

সেলফি পরিবহনের একাধিক বাসের চালক, চালকের সহকারীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকার গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া রুটে চলাচল করা এই পরিবহনের ২০০টি বাসের মধ্যে প্রতিদিন দেড় শতাধিক বাস সড়কে চলাচল করে। ৫-১০ মিনিট পরপর বাস গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সময়ে পর্যাপ্ত যাত্রী তোলা সম্ভব হয় না। তাই বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড থেকে যাত্রী নিতে হয় তাদের। এ কারণে একটি বাসের আগে অপরটি যাওয়ায় তীব্র প্রতিযোগিতা চলে এই পরিবহনের বাসগুলোর মধ্যে।

সেলফি পরিবহনের একটি বাসের চালকের সহকারী খলিলুর মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিন বাস একবার করে আপ-ডাউন করে। গাবতলী-পাটুরিয়া-গাবতলীর এই যাত্রায় সাধারণত ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা আয় হয়। খরচ হয় ৫ থেকে ৬ হাজার। গাবতলী বা পাটুরিয়া ঘাটে মাত্র চার-পাঁচ মিনিটে গাড়িতে সব যাত্রী পাওয়া যায় না। তাই অনেক চালক অন্য বাসের আগে গিয়ে রাস্তা থেকে যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতা করেন। যাত্রীরাও দ্রুত বাস চালাতে বলেন। এ কারণে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে।

সেলফি পরিবহনের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেকের

ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে চলাচলকারী একাধিক ব্যক্তি ও সড়কের শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করা সামাজিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা এ পরিবহনকে অধিকাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করছেন। দ্রুতগতিতে বাস চালানো ও নিয়ম না মেনে বাসস্ট্যান্ডের যত্রতত্র দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলা ও নামানোয় এসব দুর্ঘটনা ঘটে বলে দাবি তাঁদের।

গত বছরের জুলাইয়ে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলায় সেলফি পরিবহনের বাসের চাপায় মোটরসাইকেলের আরোহী দুই বন্ধুর মৃত্যুর ঘটনায় বিক্ষুব্ধ জনতা এই পরিবহনের দুটি বাস ভাঙচুর ও একটিতে আগুন ধরিয়ে দেন। এর আগে একই বছরের মে মাসে উপজেলার মুলজান এলাকায় সেলফি পরিবহন ও জননী পরিবহনের দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে সেলফি পরিবহনের এক যাত্রী নিহত ও উভয় বাসের অন্তত ২২ জন আহত হন। একই মাসে ধামরাইয়ের ইসলামপুর বাসস্ট্যান্ডে উল্টো পথে ঢাকাগামী লেন ধরে পাটুরিয়ার দিকে যাওয়ার সময় এক পথচারীকে ধাক্কা দিয়ে আহত করার অভিযোগ পাওয়া যায় এই পরিবহনের বাসের বিরুদ্ধে।

সেলফি দেখলে তো আগেই সড়কের পাশে মাটির রাস্তায় নেমে যাই। ভীষণ আগ্রাসী তারা। মানুষজন এতই ক্ষিপ্ত যে গত বছর আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল বাসে। সেলফি চলাচলও বন্ধ করে দিয়েছিল তখন।
মো. শামিম হোসেন, মানিকগঞ্জ শহর থেকে আরিচা রুটে মোটরসাইকেলে চলাচলকারী

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মো. শামিম হোসেন মানিকগঞ্জের আরিচা থেকে মোটরসাইকেলে করে জেলা শহরে কর্মস্থলে নিয়মিত যাতায়াত করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেলফি দেখলে তো আগেই সড়কের পাশে মাটির রাস্তায় নেমে যাই। ভীষণ আগ্রাসী তারা। মানুষজন এতই ক্ষিপ্ত যে গত বছর আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল বাসে। সেলফি চলাচলও বন্ধ করে দিয়েছিল তখন।’

সেলফি পরিবহনের যাত্রী মো. শহিদুল মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, সেলফি বাসে গেলে দ্রুত যাওয়া যায়। তবে জোরে চালানোর সময় প্রায়ই ভীষণ ভয় লাগে। তখন চালককে গালিগালাজ করলে একটু আস্তে চালান।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)–এর কেন্দ্রীয় কমিটির যুববিষয়ক সম্পাদক মো. নাহিদ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক দাপিয়ে চলছে বেশ কিছু পরিবহন, যার মধ্যে অন্যতম বেপরোয়া হচ্ছে সেলফি পরিবহন। মহাসড়কে বেপরোয়া গতি, নিরবচ্ছিন্ন বাস চলাচলের লেনে বয়স্ক নারী-পুরুষ নামিয়ে দেওয়ায় যাত্রীরা সড়ক বিভাজক টপকিয়ে পার হতে গিয়ে অনেক সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়ছেন। এসব অভিযোগের অধিকাংশ হচ্ছে সেলফি পরিবহনের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া অন্যান্য পরিবহনের বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ আছে। দ্রুত এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে।

ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক দাপিয়ে চলছে বেশ কিছু পরিবহন, যার মধ্যে অন্যতম বেপরোয়া হচ্ছে সেলফি পরিবহন। মহাসড়কে বেপরোয়া গতি, নিরবচ্ছিন্ন বাস চলাচলের লেনে বয়স্ক নারী-পুরুষ নামিয়ে দেওয়ায় যাত্রীরা সড়ক বিভাজক টপকিয়ে পার হতে গিয়ে অনেক সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়ছেন।
মো. নাহিদ মিয়া, যুববিষয়ক সম্পাদক, নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)

তবে এসব অভিযোগ সঠিক নয় বলে মনে করেন সেলফি পরিবহনের পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সড়কে আমাদের বাসগুলো বেশি চলে, তাই কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই আমাদের নাম হয়। প্রতিদিন সড়কে ২০০ গাড়ির মধ্যে ১৫০টি গাড়ি চলে। আমরা চালকদের কোনো টার্গেট দিই না, তাহলে কেন তারা সড়কে তাড়াহুড়া করবে? আমাদের সব চালকেরই লাইসেন্স আছে।’

ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস ও ট্রাফিক উত্তর বিভাগ) আবদুল্লাহিল কাফী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহাসড়কে দুর্ঘটনা রোধে বেশ কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ায় দুর্ঘটনার সংখ্যা কমে এসেছে। তবে এখনো মাঝেমধ্যে চালকদের বেপরোয়া গতিসহ আইন না মানায় দুর্ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেলফি পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে বলে শুনতে পাচ্ছি। এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে তাদের বিরুদ্ধে মামলাসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’