৭৯৫ ‘বহিরাগত’ জন্মনিবন্ধন সনদ পাওয়ার পর সেবা বন্ধ

অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে উপজেলা প্রশাসন। ইউপি চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ।

মানিকগঞ্জ জেলার মানচিত্র

মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার চরকাটারী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) থেকে অবৈধভাবে বহিরাগত ৭৯৫ জনকে জন্মনিবন্ধন সনদ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ইউপি চেয়ারম্যান ও প্রশাসনিক কর্মকর্তার সরকারি নিবন্ধন আইডি ব্যবহার করে এসব সনদ দেওয়া হয়। বিষয়টি ফাঁস হওয়ার পর দুজনের নিবন্ধন আইডি বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এতে বিভিন্ন নাগরিক সেবা পেতে ভোগান্তিতে পড়েছেন বাসিন্দারা।

এখন শিশুদের স্কুলে ভর্তির সময় চলছে। অনেক অভিভাবক জন্মসনদের জন্য আসছেন। কিন্তু জন্মসনদ করা যাচ্ছে না।
মো. খোকন মিয়া, সদস্য, ৪ নম্বর ওয়ার্ড, চরকাটারী ইউপি, ঘিওর, মানিকগঞ্জ

অভিযোগ তদন্তের জন্য গত রোববার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এ ছাড়া এ ঘটনায় ইউপি চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী মোল্লা ও সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা আলমগীর হোসেনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। ৭৯৫টি জন্মনিবন্ধন সনদও স্থগিত করা হয়েছে।

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত চরকাটারী ইউনিয়নে ৭৯৫ জনকে অবৈধভাবে জন্মনিবন্ধন সনদ দেওয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী জন্মসনদ পেতে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের বাসিন্দা হতে হবে। সংশ্লিষ্ট ইউপি সদস্যের প্রত্যয়নপত্রে সুপারিশের পর চেয়ারম্যান ও প্রশাসনিক কর্মকর্তার নিবন্ধন আইডি থেকে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে ওই ব্যক্তিকে জন্মসনদ দেওয়া হয়। তবে ৭৯৫ জন ব্যক্তি জন্মসনদ পেয়েছেন, তাঁরা এই ইউনিয়নের বাসিন্দা নন। তাঁদের জন্য ইউপি সদস্য বা সদস্যরা সুপারিশও করেননি।

ইউপির বর্তমান প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ সেলিম মোল্লা বলেন, চলতি বছরের ২০ অক্টোবর যোগদান করেছেন তিনি। এরপর ভুয়া জন্মসনদের বিষয়টি তাঁর নজরে আসে। পরে তিনি উপজেলা প্রশাসনকে জানিয়েছেন।

মানিকগঞ্জ জেলা সদর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে যমুনা নদীবেষ্টিত চরকাটারী ইউনিয়ন। নদীতে ভাঙনের কারণে ইউপি কার্যালয় পাশের টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার দপ্তিয়র ইউনিয়নের ফয়েজপুর গ্রামে স্থানান্তর করা হয়।

গত রোববার দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, যমুনা নদীর পারে ফয়েজপুর গ্রামে চরকাটারী ইউপি চেয়ারম্যান আইয়ুব আলীর বাড়ি। বাড়ির উঠানে ইউপি কার্যালয়ে তালা ঝুলছে।

 জন্মনিবন্ধন সনদ জালিয়াতির অভিযোগ ওঠার পর এক মাস ধরে ইউপি থেকে বিভিন্ন সনদ দেওয়া বন্ধ রয়েছে। ফলে জন্মসনদ এবং ওয়ারিশান সনদসহ বিভিন্ন সেবা পেতে ইউনিয়ন পরিষদে এসে সেবাগ্রহীতারা ফিরে যান। ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. খোকন মিয়া বলেন, এখন শিশুদের স্কুলে ভর্তির সময় চলছে। অনেক অভিভাবক শিশুদের জন্মসনদের জন্য ইউনিয়ন পরিষদে আসছেন। কিন্তু জন্মসনদ করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া ওয়ারিশান সনদসহ বিভিন্ন সেবা নিতে আসা মানুষজন ফিরে যাচ্ছেন।

চরকাটারী গ্রামের বাসিন্দা সুজন রানা বলেন, ভুলবশত ভুয়া জন্মসনদ হলেও দু-চারটি হতে পারে; কিন্তু ৭৯৫টি জন্মসনদ ভুল হওয়ার কথা নয়। এ কাজে শুধু ইউপি চেয়ারম্যান, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তাই জড়িত নন; বড় কোনো চক্রও জড়িত থাকতে পারে।

বিপুল আর্থিক সুবিধা নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান ভুয়া জন্মসনদ দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন চরকাটারী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মো. ওয়াজ উদ্দিন। তিনি বলেন, কোনো অসাধু চক্রের সঙ্গে যোগসাজশ করে চেয়ারম্যান এসব ভুয়া জন্মসনদ দিয়েছেন। এর সঙ্গে তৎকালীন প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও উদ্যোক্তাও জড়িত থাকতে পারেন।

এ বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কম্পিউটারের কাজ বুঝি না। পরিষদের উদ্যোক্তা জলিল মণ্ডলের কাছে আমার জন্মনিবন্ধনের আইডির পাসওয়ার্ড থাকত। সেই সুযোগে উদ্যোক্তা জলিল এ রকম অবৈধ জন্মনিবন্ধন করেছে।’

বক্তব্য জানতে ফয়েজপুর গ্রামে জলিল মণ্ডলের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাঁর মুঠোফোন নম্বরও বন্ধ পাওয়া গেছে। তৎকালীন প্রশাসনিক কর্মকর্তা আলমগীর হোসেনের নম্বরও বন্ধ।

ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আহসানুল আলম বলেন, নিয়মবহির্ভূতভাবে জন্মসনদ করার তথ্য পাওয়ার পর তিনি বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ইতিমধ্যে তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ইউপি চেয়ারম্যান ও প্রশাসনিক কর্মকর্তার নিবন্ধন আইডি বন্ধ রাখা হয়েছে। অবৈধ যে ৭৯৫টি জন্মসনদ দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো স্থগিত রাখা হয়েছে। জন্মসনদসহ অন্যান্য নাগরিক সেবা দিতে অন্য একজন সরকারি কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হবে।