‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ১০ দফা’ দাবিতে জেলায় জেলায় বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচিতে আজ শনিবার চার জেলায় সংঘাতের খবর পাওয়া গেছে। তিনটি জেলায় পুলিশি বাধার মুখে পড়েছে বিএনপির কেন্দ্রঘোষিত এই কর্মসূচি। একটি জেলায় কর্মসূচির আগে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।
আজ শনিবার বিকেল ৪টা পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী, ঝালকাঠিতে পদযাত্রায় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে তিন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। পুলিশ লাঠিপেটা করে পদযাত্রা ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পটুয়াখালীতেও পদযাত্রায় পুলিশের লাঠিপেটায় বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। নেত্রকোনায় পদযাত্রায় অংশ নিতে জড়ো হওয়া নেতা-কর্মীদের ওপর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। নাটোরে কর্মসূচির আগে মোটরসাইকেল বহর থেকে বিএনপির কার্যালয়ের পাশে ককটেল নিক্ষেপ করা হয়েছে। বাগেরহাটে পদযাত্রায় বাধা পুলিশ অন্তত ৪০ নেতা-কর্মীকে আটক করেছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। নীলফামারীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
বিদ্যুৎ-গ্যাস, চাল-ডাল, তেল, চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমানো, দমন-নিপীড়ন বন্ধ করা, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ কারাবন্দী নেতা-কর্মীদের মুক্তি, সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিল করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনসহ ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ১০ দফা’ দাবিতে আজ শনিবার জেলায় জেলায় পদযাত্রা কর্মসূচির ঘোষণা করে বিএনপি। এসব কর্মসূচিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ কেন্দ্রীয় নেতারা অংশ নেন।
বিএনপির পদযাত্রার পাল্টা শান্তি সমাবেশের কর্মসূচি নিয়ে আজকেও মাঠে ছিল আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ। আজ জেলা ও মহানগর পর্যায়ে শান্তি সমাবেশের কর্মসূচি রয়েছে যুবলীগের।
নেত্রকোনায় আজ সকালে পদযাত্রা কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার জন্য প্রতিটি উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড থেকে বিএনপি এবং অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা শহরের পারলা বাসস্টেশন, বনোয়াপাড়া, কুড়পাড়, মোক্তারপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় জড়ো হতে থাকেন। বিএনপির অভিযোগ, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে জড়ো হওয়া বিএনপি নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালান। এ সময় ব্যানার, ফেস্টুন ছিনিয়ে নিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া, মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাস ভাঙচুরসহ বেশ কিছু ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কুড়পাড় এলাকায় পুলিশ দুইটি ফাঁকা গুলি ছোড়ে। হামলায় বিএনপির অন্তত ২৩ জন আহত হন।
জেলা বিএনপির সদস্যসচিব মো. রফিকুল ইসলাম হিলালী বলেন, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের হামলায় বিএনপির ২৩ নেতা-কর্মী আহত হন। এরপর পুলিশ উল্টো বিএনপির ৫ নেতা-কর্মীকে আটক করে নিয়ে যায়। তবে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. শামছুর রহমান বলেন, বিএনপির নিজেদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে মারামারি করে কেউ আহত হতে পারে।
নেত্রকোনা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খন্দকার শাকের আহমেদ বলেন, আজ সকালে শহরের বেশ কয়েকটি স্থানে বিএনপির নেতা-কর্মীরা ঝামেলার চেষ্টা করেছিলেন। সেখান থেকে দুইজনকে আটক করা হয়েছে। আর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ দুইটি ফাঁকা গুলি ছুড়েছে।
নীলফামারীতে শহরের পৌর সুপারমার্কেটের সামনে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শান্তি সমাবেশ শুরু করে জেলা আওয়ামী লীগ। একই সময়ে পাশে দলীয় কার্যালয়ের সামনে পদযাত্রার জন্য সমবেত হন জেলা বিএনপির একাংশের নেতা-কর্মীরা। এ সময় জেলা আওয়ামী লীগের সভাস্থল থেকে কয়েকজন যুবক বিএনপির সভাস্থলে হামলা চালিয়ে তাদের টাঙানো ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে চেয়ার ভাঙচুর করেন। এতে করে উভয় পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মমতাজুল হক বলছেন, তাঁরা সভা শুরু করলে বিএনপি নেতা-কর্মীরা উসকানিমূলক ও অশ্লীল বক্তব্য দিতে থাকেন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এর প্রতিবাদ করলে উদ্ভূত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
তবে জেলা জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী আক্তারুজ্জামান বলেন, বিনা উসকানিতে আওয়ামী লীগ হামলা চালিয়ে ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে ও চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করে। এতে বেশ কিছু নেতা-কর্মী আহত হন।
ঝালকাঠিতে জেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা সকাল ১০টার আগেই শহরের আমতলা সড়কের দলীয় কার্যালয় জড়ো হতে শুরু করেন। সেখানে আগে থেকেই পুলিশ অবস্থান নেয়। নেতা-কর্মীরা সাড়ে ১০টার দিকে সেখান থেকে পদযাত্রা শুরু করেন। মিছিলটি সাধনার মোড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ বাধা দেয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বাধা উপেক্ষা করে নেতা-কর্মীরা পদযাত্রাটি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাইলে পুলিশ মৃদু লাঠিপেটা করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। ইটের আঘাতে ওই তিন পুলিশ কর্মকর্তার মাথা ফেটে যায়। একপর্যায়ে পুলিশ বেধড়ক লাঠিপেটা শুরু করে।
লাঠিপেটায় শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন দাবি করে জেলা বিএনপির সদস্যসচিব শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ পদযাত্রায় পুলিশ বিনা উসকানিতেই লাঠিপেটা শুরু করে। অন্যায়ভাবে ১৫ নেতা-কর্মীকে আটক করেছে। জেল-জুলুম ও লাঠিপেটা করে আমাদের আন্দোলন দমিয়ে রাখা যাবে না।’
ঝালকাঠি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাসির উদ্দিন সরকার বলেন, বিএনপির নেতা-কর্মীরা মিছিল থেকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে তিন পুলিশ কর্মকর্তার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছেন। এ ঘটনায় অন্তত ১৬ জনকে আটক করা হয়েছে। মামলার প্রস্তুতি চলছে।
পটুয়াখালীতে শহরের বনানী এলাকায় দলীয় কার্যালয়ের সামনে প্রথমে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে জেলা বিএনপি। সমাবেশে শেষে পদযাত্রা শুরু হয়ে পৌরসভা মোড়ে যাওয়ার পথে পুলিশ পেছন থেকে ধাওয়া দিয়ে লাঠিপেটা শুরু করে। এতে নেতা-কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান।
জেলা বিএনপির সদস্যসচিব স্নেহাংশু সরকার বলেন, ধাওয়ার সঙ্গে নেতা-কর্মীদের লাঠিপেটা শুরু করে পুলিশ। এ সময় নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে ব্যানার-ফেস্টুন কেড়ে নেওয়া হয়। এ ঘটনায় বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন।
এ ব্যাপারে পটুয়াখালী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, এমনিতেই জেলা বিএনপিতে দ্বন্দ্ব রয়েছে। কে সামনের সারিতে থাকবে, কে বক্তব্য রাখবে, এসব নিয়ে নিজেদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হলে শহরের পরিবেশ ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে পুলিশ এ পদক্ষেপ নেয়।
নাটোরে নাটোরে বিএনপির পদযাত্রা শুরুর আগে মোটরসাইকেলের বহর থেকে ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। আজ শনিবার সকাল পৌনে আটটার দিকে শহরের আলাইপুরে জেলা বিএনপির কার্যালয়ের পাশে একে একে ছয়টি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। পরে পুলিশবেষ্টিত অবস্থায় বিএনপি পদযাত্রা কর্মসূচি শেষ করে।
নাটোর শহর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান খান চৌধুরীর দাবি, ওই মোটরসাইকেলের বহরে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা ছিলেন। তাঁরা বিএনপি নেতা-কর্মীদের ভয় দেখানোর জন্য ককটেল ফাটিয়েছেন।
তবে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ফরহাদ বিন আজিজ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর মতে, বিএনপি নিজেরাই ককটেল ফাটিয়ে সত্য ধামাচাপা দিচ্ছে।
ককটেল বিস্ফোরণের বিষয়ে নাটোর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাছিম আহম্মেদ বলেন, পুলিশ বিএনপির কর্মসূচিস্থলে যাওয়ার পর এমন ঘটনা ঘটেনি। সকালের দিকে বিএনপি কার্যালয় থেকে কিছুটা পশ্চিমে কয়েকটা শব্দ হয়েছে এবং কিছু জর্দার কৌটা পড়ে আছে বলে শুনেছেন। তাঁরা ঘটনাটি তদন্ত করে দেখছেন।
বাগেরহাটে বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচিতে বাধা দিয়েছে পুলিশ। এ সময় শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে দলের ৪০ নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে দাবি করেছে বিএনপি। আজ শনিবার সকাল পৌনে ১০টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত শহরের মুনিগঞ্জ, পুরাতন বাজার ও থানার মোড় এলাকা থেকে আটকের ঘটনা ঘটে।
বাগেরহাটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের কর্মসূচি ছিল। শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে পুলিশের পক্ষ থেকে বিএনপিকে কর্মসূচি স্থগিতের জন্য বলা হয়েছিল। তারা তা না মেনে আগ্রাসীভাবে কর্মসূচি পালন এবং নাশকতার চেষ্টা করে। এ সময় পুলিশ ২০-২৫ জনকে আটক করেছে। আটক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।ৎ
গাজীপুরে শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টার পরে দলীয় কার্যালয় থেকে পদযাত্রা বের করেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। পদযাত্রাটি দলীয় কার্যালয় থেকে জোরপুকুর পর্যন্ত যাওয়ার কথা থাকলেও পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেয়। পরে ৫০ গজ সামনে গিয়ে পদযাত্রাটি শেষ হয়। মাগুরাতে পুলিশের বাধার কারণে দলীয় কার্যালয় থেকে ২০০ মিটার পর্যন্ত পদযাত্রা করতে পেরেছে বিএনপি।
এর আগে ১১ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রা করেছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। এতে অন্তত ৪০টি জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে কর্মসূচিতে হামলার শিকার হওয়ার অভিযোগ করেছে বিএনপি।
এরপর ১৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেটসহ ১১টি মহানগরে পদযাত্রা কর্মসূচি করে দলটি। ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগরের উত্তর ও দক্ষিণে দুটি পদযাত্রা কর্মসূচি হয়।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]