জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নড়বড়ে, জেনেও পদক্ষেপ নেই
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত তিন মাসে চুরি, ছিনতাই, নির্যাতনের অন্তত ৫০টি ঘটনা ঘটেছে। সরকারি ছুটিসহ জাতীয় দিবসে দর্শনার্থীদের ঢল নামা এ ক্যাম্পাসের সুরক্ষায় নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তাপ্রহরী। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোর বেশির ভাগ জায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরা নেই। বহিরাগতদের অবাধ প্রবেশ ও নড়বড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে এসব ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
নিরাপত্তা সংকটের বিষয়গুলো অনেক আগেই প্রশাসনকে জানিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখার প্রধান সুদীপ্ত শাহীন। গত সোমবার ফেসবুকে বিস্তারিত পোস্ট করে তিনি ওই দাবি করেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, প্রশাসনের দায়িত্বহীনতা ও অদূরদর্শিতার কারণে ঘটনাগুলো ঘটছে। নিরাপত্তা ঘাটতির বিষয়টি প্রশাসন জানে। বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীরা আন্দোলনও করেছে। কিন্তু প্রশাসন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
তবে উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন কোনো বিষয় আমাকে জানানো হয়নি। এ সংক্রান্ত বিষয়গুলো প্রক্টর দেখেন। তাঁকে জানালে জানাতে পারেন।’ প্রক্টর আ স ম ফিরোজ উল হাসান বলেন, ‘ইনফরমালি আলাপের সময় অনেক বিষয়েই কথা হয়। তবে অফিশিয়ালি এমন কোনো বিষয়ে আমাকে জানানো হয়নি। কিছু ঘটনা ঘটে, নিরাপত্তা কর্মকর্তারা সমাধান করে আমাকে শুধু জানিয়ে দেন।’
তিন মাসে অর্ধশত ঘটনা
তিন মাসে ছিনতাই, চুরি, মারধরসহ অন্তত ৫০টি ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর রাতে পরিবহন চত্বরে বহিরাগত তিনজনকে আটক করে ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। নিরাপত্তাকর্মীদের উপস্থিতিতে তাঁরা সে যাত্রায় রক্ষা পান। পরদিন বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজ মাঠে এক মোবাইল মেকানিককে তুলে এনে চাঁদা দাবি করা হয়। এ ঘটনায় দুজন শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশে দেয় প্রশাসন। ২২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র এলাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক এক শিক্ষার্থীকে আটক করে মোবাইল ও টাকাপয়সা ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনার আগে-পরে কয়েক দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত ১০টি সাইকেল চুরির ঘটনা ঘটে।
চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বান্ধবীকে নিয়ে মীর মশাররফ হলের ফটকের সামনে গেলে তাঁর টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এ ঘটনায় আশুলিয়া থানায় একটি অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী। ১৯ জানুয়ারি পাখি মেলায় ঘুরতে এসে গণবিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী সপ্তম ছায়ামঞ্চ এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হন। ২০ জানুয়ারি একই জায়গায় গাবতলী থেকে বান্ধবীকে নিয়ে ঘুরতে এসে ছিনতাইয়ের শিকার হন আরেক ব্যক্তি। সর্বশেষ গত শনিবার রাতে বহিরাগত এক দম্পতিকে ডেকে স্বামীকে মীর মশাররফ হোসেন হলের একটি কক্ষে আটকে তাঁর স্ত্রীকে পাশের জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় আশুলিয়া থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হয়েছে।
বিভিন্ন সময়ে ছাত্রীদের হলে রাতের বেলায় চুরির ঘটনা ঘটে। গত বছরের ৭-১১ মার্চ চার দিনের ব্যবধানে দুবার বেগম খালেদা জিয়া হল, শেখ হাসিনা হল ও বেগম সুফিয়া কামাল হলে চুরির চেষ্টার ঘটনা ঘটে। এর আগে গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর রাত আড়াইটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন ফজিলাতুন্নেছা হলেও চুরি হয়।
দর্শনার্থীদের ঢলে অরক্ষিত ক্যাম্পাস
সাপ্তাহিক ছুটির দিনসহ বিভিন্ন দিবস ও উৎসবে ক্যাম্পাসে দর্শনার্থীদের ঢল নামে। অপর্যাপ্ত নিরাপত্তাপ্রহরী দর্শনার্থীদের ঢল সামলাতে পারেন না। গত এক সপ্তাহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, প্রধান ফটক ও জয় বাংলা ফটক দিয়ে প্রতিদিন বিকেলে ও ছুটির দিনে সকাল থেকেই দলে দলে বহিরাগত প্রবেশ করছেন। যাঁদের বেশির ভাগই তরুণ-তরুণী এবং সাভার ও আশুলিয়ার বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক। নম্বর প্লেটবিহীন মোটরসাইকেলে কয়েকজন তরুণকে ক্যাম্পাসে শো-ডাউন দিতে দেখা যায়।
নিরাপত্তারক্ষীরা জানান, ফটকগুলোতে শুধু গাড়ি নিয়ে আসা ব্যক্তিদের পরিচয় ও কারণ জিজ্ঞেস করে সদুত্তর না পেলে তাঁরা ফেরত পাঠান তাঁরা। অনেক সময় তাঁরা বহিরাগতদের নির্যাতনের শিকার হন। ২২ ডিসেম্বর বহিরাগত কয়েকজন গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করতে চাইলে বাধা দেন নিরাপত্তা প্রহরীরা। এ ঘটনায় বাগ্বিতণ্ডার একপর্যায়ে গাড়িচালক নিরাপত্তা প্রহরীকে মারধর করেন। লোকবল সংকটের কারণে অনেক সময় সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারেন না। এ ছাড়া গেরুয়া, আমবাগান ও পরিবহন কার্যালয়-সংলগ্ন ফটক পুরোপুরি অরক্ষিত বলে তাঁরা জানান।
নিরাপত্তা শাখার তথ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ৯০ জন নিরাপত্তারক্ষী কাজ করছেন। এ ছাড়া ৯২ জন আনসার সদস্য আছেন। পালাভিত্তিক তাঁরা দায়িত্ব পালন করেন। একই সময়ে পুরো ক্যাম্পাসে দায়িত্ব পালন করতে পারেন ৫০-৬০ জন। প্রয়োজনের তুলনায় যা অপ্রতুল। এ ছাড়া কোনো নারী নিরাপত্তারক্ষী এবং নারী নিরাপত্তা কর্মকর্তা নেই। এ জন্য নারীঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা শাখা ব্যবস্থা নিতে পারেন না।
প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন প্রথম আলোকে বলেন, এখনো ৫০ জন প্রহরী দরকার। নারী নিরাপত্তা কর্মকর্তা না থাকায় নারীঘটিত বিষয়ে তাঁরা কিছু করতে পারেন না। জনবল বাড়াতে কয়েকবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। নিরাপত্তা শাখার মাইক্রোবাসটিরও অবস্থা বেহাল। বিভিন্ন সময় বহিরাগতের অপরাধের জন্য ধরলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কল দেন। তখন তাঁদের কিছুই করার থাকে না।
নেই পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরা
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্টরা জানান, সার্বিক নিরাপত্তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ অন্তত ৫০টি পয়েন্টে সিসিটিভি ক্যামেরা প্রয়োজন। কিন্তু বেশির ভাগ জায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরা নেই। যেসব পয়েন্টে ক্যামেরা আছে, সেগুলোর অধিকাংশই অকেজো। খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে দুটি সিসিটিভি ক্যামেরা থাকলেও তা অকেজো হয়ে আছে।
উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউজিসি জনবল নিয়োগের জন্য পদ না দিলে কীভাবে নিয়োগ দেব? আমরা মেয়েদের হলে একজন করে নারী নিরাপত্তারক্ষী দেওয়ার চেষ্টা করছি। পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে চুরি-ছিনতাইয়ের বিষয়টি দেখেছি। কিন্তু কখনো কারও কোনো অভিযোগ পাইনি।’
বহিরাগতদের নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনকেই দায়িত্ব নিতে হবে বলে মত দেন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম রববানী। তিনি বলেন, বহিরাগতরা ক্যাম্পাসে আসবেন শিক্ষা ও গবেষণা-সংশ্লিষ্ট কাজে। সবাইকে বোঝাতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় বিনোদনকেন্দ্র নয়। প্রতিনিয়ত যে চুরি-ছিনতাই, নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে, এর দায় অবশ্যই প্রশাসনকে নিতে হবে।