চকরিয়ায় ১২ একর প্যারাবন নিধন, ৩০ জনের নামে মামলা

চকরিয়ার বদরখালীর প্যারাবন নিধনের চিত্রফাইল ছবি

কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বদরখালী এলাকায় ১২ একর প্যারাবন নিধনের অভিযোগে ৩০ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। মামলায় এ ছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় ১০ থেকে ১২ জন ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের বেশির ভাগই স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয়। গত বুধবার চকরিয়া থানায় মামলাটি করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কক্সবাজার কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ রসায়নবিদ মো. আবদুছ ছালাম।

মামলায় অভিযোগ করা হয়, গত বছরের ২০ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারির মধ্যে আসামিরা বদরখালী বাজারের দক্ষিণে টুটিয়াখালী পাড়ার পশ্চিমে ১০ একর এবং বদরখালী-মহেশখালী ব্রিজের দক্ষিণে ২ একর প্যারাবন নিধন করেন। পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শন করে ১২ একর প্যারাবন নিধনের সত্যতা পেয়েছেন। মাছ ও কাঁকড়ার ঘেরের জন্য বাঁধ তৈরি করতে এসব প্যারাবন নিধন করা হয়। গত ১৩ জানুয়ারি বদরখালী ব্রিজের দক্ষিণে মহেশখালী চ্যানেলের পূর্ব পাশে ২ ফুট উঁচু, ৫ ফুট প্রস্থ ও ৩০০ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি বাঁধ নির্মাণ করেন আসামিরা। প্যারাবন নিধন করে শ্রমিকদের দিয়ে খালের ওপর এই বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। খালে বাঁধ নির্মাণের ফলে জলাশয়, পরিবেশ ও প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে।

গত ১৪ জানুয়ারি প্রথম আলোয় ‘প্যারাবন নিধন করে চিংড়িঘেরের বাঁধ’ শিরোনামে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। খবর প্রকাশের পর ১৭ জানুয়ারি চকরিয়া উপজেলা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাহিদ হোসাইন স্বপ্রণোদিত হয়ে একটি মামলা করেন। ঘটনার সত্যতা যাচাই করে ৩০ দিনের মধ্যে আদালত প্রতিবেদন দিতে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের পরিচালককে নির্দেশ দেন। তবে আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নাম বাদ দিয়ে ১৩ জন নিরীহ ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করার অভিযোগ উঠে পরিবেশ অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে ১০ অক্টোবর প্রথম আলো অনলাইনে ‘দখলদারদের নাম বাদ দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন পরিবেশ অধিদপ্তরের’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর ২১ অক্টোবর ‘পরিবেশ অধিদপ্তরের এ কেমন প্রতিবেদন’ শিরোনামে সম্পাদকীয় প্রকাশ হয় প্রথম আলোতে। ওই দিনই কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ রসায়নবিদ মো. আবদুছ ছালাম সরেজমিন প্যারাবন নিধনের স্থান পরিদর্শন করে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেন। পরে ৩০ জনকে আসামি করে চকরিয়া থানায় মামলা করেন তিনি।

মামলায় বদরখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য গোলাম কাদের ওরফে মনু, সাবেক ইউপি সদস্য তাজুল ইসলামের নাম রয়েছে। আসামি করা হয়েছে ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রহিমকেও। এ ছাড়া আসামির তালিকায় রয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল কাদের, সাহাব উদ্দিন ও মোহাম্মদ আলী চৌধুরী। তাঁরা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। মোহাম্মদ আলী চৌধুরী বদরখালী সমবায় কৃষি ও উপনিবেশ সমিতির সাবেক সম্পাদক।

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে কক্সবাজারের চকরিয়ার বদরখালী উপকূলে কয়েক শ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় কয়েক হাজার ঘরবাড়ি। এরপর জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মানুষের জানমাল রক্ষার জন্য বদরখালী নদী–তীরের ৩ কিলোমিটারজুড়ে অন্তত ৪০ হাজার কেওড়া ও বাইনগাছের চারা রোপণ করে বেসরকারি সংস্থা উবিনীগ। ১৯৯৬, ২০০০, ২০০৩ ও ২০১৯ সালে চার দফায় এসব গাছ রোপণ করা হয়।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে জানা যায়, প্যারাবন কেটে চিংড়িঘের নির্মাণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য জাফর আলমের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

উবিনীগের আঞ্চলিক সমন্বয়ক জয়নাল আবেদিন খান প্রথম আলোকে বলেন, আদালতের আদেশে যখন দখলদারদের বিষয়ে তদন্ত চলছিল তখন উবিনীগের পক্ষ থেকে প্যারাবন নিধনে জড়িত অন্তত ৪০ জনের একটি তালিকা এবং প্যারাবন নিধনের ভিডিও চিত্র পরিবেশ অধিদপ্তরে সরবরাহ করা হয়েছিল। ভিডিওতে প্যারাবন নিধনকারী ব্যক্তিদের সহজে শনাক্ত করা যায়। এরপরও প্রকৃত দখলদারদের নাম বাদ দিয়ে নিরীহ ও দরিদ্র ১৩ জনের নামে প্রতিবেদন দিয়েছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। অথচ থানায় করা মামলায় উবিনীগের সরবরাহ করা তালিকার ৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

চকরিয়া থানায় হওয়া মামলার কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ২৪ সেপ্টেম্বর আদালতে দাখিল করা প্রতিবেদনে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তাঁদের একজনের নামও চকরিয়া থানায় করা মামলার আসামি তালিকায় নেই। অথচ পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক ফাইজুল কবির বলেছিলেন, সরেজমিন অনুসন্ধান করে প্যারাবন নিধনের সঙ্গে তিনি যাঁদের সম্পৃক্ততা পেয়েছেন, তাঁদের অভিযুক্ত করা হয়েছে। উবিনীগের পক্ষ থেকে যাঁদের তালিকা জমা দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তাঁদের সম্পৃক্ততার বিষয়েও কেউ সাক্ষ্য দেননি।

চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনজুর কাদের ভূঁইয়া বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বাদী হয়ে ৩০ জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করেছেন। মামলাটি পরিবেশ অধিদপ্তরই তদন্ত করবে।

পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপপরিচালক জমির উদ্দিন বলেন, আগের তদন্তের সময় তিনি দায়িত্বে ছিলেন না। এখন করা মামলা পরিবেশ অধিদপ্তর তদন্ত করবে এবং প্রকৃত দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।