শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বিলাসপুর ইউনিয়নের মুলাই ব্যাপারিকান্দি গ্রামে বাসি বিরিয়ানি খেয়ে তিন ভাই-বোনের মৃত্যুর ঘটনাটি মানতে পারছেন না কেউ। পরিবারের অভিযোগ, কীটনাশকের প্যাকেটে ভরে বিরিয়ানি এক সপ্তাহ আগে ফ্রিজে রাখা হয়েছিল। ওই বিরিয়ানি খেয়ে দুই দিনে তিন ভাই-বোনের মৃত্যু হয়েছে।
এ ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে গত বৃহস্পতিবার রাতে জাজিরা থানায় একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা হয়েছে। বাসি বিরিয়ানি খাওয়ার পর গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাথী আক্তার (১৪) নামের কিশোরীর মৃত্যু হয়। এর আগে মঙ্গলবার দিবাগত রাতে সৌরভ (৬) ও খাদিজা (৫) নামের দুই ভাই-বোন মারা যায়। এই তিন শিশু মুলাই ব্যাপারিকান্দি গ্রামের শওকত দেওয়ান ও আইরিছ বেগম দম্পতির সন্তান। শওকত ভ্যান চালিয়ে সংসার চালান। সাথী আক্তার স্থানীয় কাজিয়ারচর হামিদিয়া শুকুরিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছিল।
পরিবার ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবেশী আনোয়ার শেখের মেয়ের কাবিনের অনুষ্ঠান হয় ১০ আগস্ট। সেখানে অতিথিদের বিরিয়ানি খাওয়ানো হয়েছিল। অনুষ্ঠানের পর কিছু বিরিয়ানি অবশিষ্ট থাকে। ওই বিরিয়ানি আনোয়ারের স্ত্রী রওশন আরা বেগম ফ্রিজে রেখে দেন। তিনি কীটনাশকের একটি প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে খাবারগুলো ফ্রিজে রেখেছিলেন। গত মঙ্গলবার দুপুরে শওকত ও আইরিছ দম্পতির মেয়ে খাদিজা ও ছোট ছেলে সৌরভ ওই বাড়িতে যায়। তখন রওশন ওই দুই শিশুকে ফ্রিজে রাখা বিরিয়ানি খেতে দেন। তারা তা খেয়ে কিছু বিরিয়ানি একটি পাত্রে করে বাড়িতে নিয়ে আসে। বাড়িতে আনার পর ওই খাবার তাদের বড় বোন সাথী খায়। সাথী খাওয়ার পর তার মাকে জানায়, পাশের বাড়ির চাচি পচা বিরিয়ানি দিয়েছেন, তা তারা খেয়েছে। সাথীর মা আইরিছ ওই বিরিয়ানি মুখে দিয়ে দেখেন তা পচা, টক হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বমি করে ফেলেন। তখন তিনি সন্তানদের বকাঝকা করেন, কেন এমন খাবার তারা খেয়েছে।
ওই তিন শিশুর খালা রিতা আক্তার বলেন, ‘মানুষ গরিব হলেই তাকে পচা-বাসি খাবার দিতে হবে? শিশুরা ওই খাবার খেলে বিপদ হতে পারে তা একবার ভেবেও দেখল না? বোনের ছেলে–মেয়েরা অসুস্থ হওয়ার পরও রওশন আরা বলেননি কীটনাশকের খালি প্যাকেটে বিরিয়ানি রাখা হয়েছিল। যখন লাশের পোস্টমর্টেম করার কথা শুনেছে, তখন তারা জানিয়েছে, কীটনাশকের প্যাকেটে খাবার রাখার কথা। এটা অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড। আমরা এর বিচার চাই।’
গতকাল শুক্রবার দুপুরে মুলাই ব্যাপারিকান্দি গ্রামে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পরিবারটির অন্য সদস্যরা হতবিহ্বল। শিশুদের মা আইরিছ বেগম কাঁদতে কাঁদতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। মারা যাওয়া তিন শিশুর অপর দুই ভাই-বোন কান্না করছে। স্বজনেরা তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। গ্রামের মানুষ ও প্রতিবেশীরা বাড়িতে ভিড় করেছেন। ঘটনার বর্ণনা শুনে উপস্থিত অনেকেই চোখের পানি ফেলেছেন।
কান্নারত অবস্থায় আইরিছ বেগম বলেন, ‘কৃষি জমির ঘাসে দেওয়া কীটনাশকের খালি প্যাকেটে ভরে বিরিয়ানি ফ্রিজে রাখছিল রওশন আরা। সে কেন জেনেশুনে আমার বাচ্চাগুলোকে এমন খাবার খাওয়াল? আমার মানিকগুলানরে তো আমি শাক–পাতা খাওয়াইয়া বাঁচাইয়া রাখছিলাম। আল্লারে আমি এখন কী নিয়া বাঁচুম।’
ওই শিশুদের ফুফু রুপালি আক্তার বলেন, ‘রওশন আরাদের সঙ্গে তো তাঁদের কোনো শত্রুতা নেই। তাহলে সে কেন এমন করল! তিন সন্তান হারিয়ে আমার ভাই-ভাবি কী নিয়ে বাঁচব?’
শিশু খাদিজা ও সৌরভের মারা যাওয়ার খবর পাওয়ার পরই আনোয়ার হোসেন ও তার স্ত্রী রওশন আরা বাড়ি থেকে চলে গেছেন। তাদের বাড়িতে গিয়ে পাওয়া যায় রওশন আরার মা আলেয়া বেগমকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাতনির কাবিনের সময় কিছু খাবার বেঁচেছিল। ওই খাবারগুলো ফ্রিজে রাখা হয়েছিল। সেই খাবারই আমার মেয়ে শিশুদের খেতে দিয়েছিল। কীভাবে কী হয়ে গেল আমরা বুঝতে পারছি না। মঙ্গলবার রাত থেকে মেয়ে ও জামাই গ্রামে নেই। তারা ঢাকায় গেছে। কবে আসবে তা জানি না।’
জাজিরা থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিরিয়ানি খেয়ে তিনজনের মৃত্যুর ঘটনাটি তদন্ত করা হবে। এ ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।