‘আয়ের সঙ্গে পেরে উঠছি না, নিজের এলাকায় চলে যাব’

খুলনা শহরের পথে পথে হেঁকে যান চুলের ফেরিওয়ালা শারিফুল। তবে তাঁর সকালটা কাটে খেজুর গুড় বিক্রি করে
ছবি: প্রথম আলো

‘বেচবেন চুল? অই, চুল বেচবেন, চুল?’ ভেঁপু বাঁশিতে আওয়াজ তুলে খুলনা শহরের পথে পথে হেঁকে যান চুলের ফেরিওয়ালা শারিফুল। তবে ‘চুলওয়ালা’ শারিফুলের সকালটা কাটে খেজুর গুড় বিক্রি করে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব পাশে গল্লামারী লিনিয়ার পার্ক এলাকায় হল রোড বাজারে প্রতিদিন ভোর থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত খেজুর গুড় বিক্রি করেন তিনি।

সেখানেই কথা হয় শারিফুলের সঙ্গে। তাঁর বয়স এখন ৩৭ বছর। বাড়ি চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার জয়রামপুর গ্রামে। গ্রামে মানুষ তাঁকে চেনে ‘সার্থক’ নামে। ছোট থেকেই অভাবের সঙ্গে সংগ্রাম তাঁর। ছয় ভাইবোনের বড় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো তাঁর কৃষক বাবাকে। বাবাকে সহযোগিতা করতে গিয়ে কখনোই স্কুলে যাওয়া হয়ে ওঠেনি তাঁর।

শারিফুল বলেন, ‘আর্থিক অবস্থায় কুলায়নি, তাই পড়ালেখা হয়নি। খাইটে খাওয়া লাগিছে। ছোটবেলা থেকে গরুর দেখাশুনা করতাম। মোট কথা মাঠে রাখালের কাজ করতাম। বয়স যখন ১৩-১৪, তখন চুয়াডাঙ্গা শহরে রিকশা চালানো শুরু করছি। পাঁচ বছর ধরে প্রতিদিন সকালে যাইতাম আর সন্ধ্যায় চলে আসতাম।’

বছর পাঁচেক রিকশা চালানোর পর পেশায় পরিবর্তন আনেন শারিফুল। একটা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে হয়ে ওঠেন গরু-ছাগলের ব্যাপারী। বিভিন্ন গ্রাম থেকে গরু, ছাগল কিনে নিয়ে যেতেন চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহের বিভিন্ন হাটবাজারে। নতুন ব্যবসা ভালো চলতে থাকে, এদিকে শুরু করেন নতুন জীবন। প্রায় বছর দশেক গরু-ছাগল কেনাবেচার পেশায় থাকার পর শারিফুল বেছে নেন মাংস বিক্রির পেশা। বাড়ির পাশে কাঁঠালতলা বাজারে কসাইয়ের কাজ শুরু করেন। তবে ওই পেশায় শেষ পর্যন্ত মন বসাতে পারেননি। বছরখানেক কসাইয়ের কাজ করার পর তাঁর ঠিকানা হয় খুলনা শহরে। শ্বশুরবাড়ির অনেকে চুলের ব্যবসা করতেন খুলনায়। তাঁদের পরামর্শে খুলনায় এসে বেছে নেন চুলের ফেরিওয়ালার জীবন। এরপর গত ছয় বছর জীবিকার তাগিদে এই শহরের পথে পথে হাঁটছেন শারিফুল। শহর ছেড়ে মাঝেমধ্যে ডুমুরিয়া ও বটিয়াঘাটার গ্রামের পথে পা বাড়াতে হয় তাঁকে।

কথায় কথায় জানা গেল, অনেক নারী চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ানোর পর যে চুল পড়ে, তা ফেলে না দিয়ে গুছিয়ে রাখেন বিক্রির জন্য। চুলের বিনিময়ে টাকার পাশাপাশি অনেক ফেরিওয়ালা দেন কসমেটিকস পণ্য, বেলুন, গাড়ি, বাঁশি, ছোট ছোট হাঁড়ি-পাতিল ইত্যাদি। তাঁরা মূলত সাইকেল নিয়ে বের হন। অনেকে আবার শুধু একটা বাঁশি আর হাতে ব্যাগ নিয়ে হেঁটে হেঁটে চুল কেনেন। শারিফুল দ্বিতীয় দলের।

শারিফুল বলেন, ‘আমার সঙ্গে থাকে ব্যাগ, একটা পাল্লা-পোড়েন আর বাঁশি। রূপসা ঘাট থেকে বয়রা বাজার আর এদিকে রূপসা সেতু পর্যন্ত এলাকার মধ্যেই আমার চলাফেরাটা বেশি হয়। সাত হাজার টাকা কেজি দরে সাধারণত চুল কিনি। দিনে ৩০০ থেকে ৬০০ গ্রাম পর্যন্ত চুল কেনা যায়। কোনো দিন আবার একপ্রকার খালি হাতেই, মানে ফাও ঘুরে আসতে হয়।’

মাসে চুল বিক্রি করে ১৭-১৮ হাজার টাকা শারিফুল নিজের পকেটে ঢোকাতে পারেন। সকাল ১০টার দিকে বের হয়ে সর্বোচ্চ পাঁচটা পর্যন্ত চুল কেনেন তিনি। এরপর বাসায় ফিরে চুলের বাছাইয়ের কাজ সারেন। তিনি চুল বিক্রি করেন ঢাকায়। ইঞ্চি অনুয়ায়ী চুলের গ্রেডিং করা হয়। ৬ ইঞ্চি থেকে ২৮ ইঞ্চি পর্যন্ত বিভিন্ন রকম গ্রেড আছে। বিক্রির সময় ৮০০ টাকা কেজিও আছে, আবার ৪০ হাজার টাকা কেজিও আছে বলে জানান তিনি।

গত বছর থেকে শারিফুল শীত মৌসুমে খেজুর গুড় বিক্রি করছেন। এ বছর দুই দফায় গুড় এনেছেন। এখন পর্যন্ত প্রায় ২০০ কেজি গুড় বিক্রি হয়েছে। সকালের এই ব্যবসা থেকে প্রতিদিন শ তিনেক টাকা আয় হয়। তিনি বলেন, ‘গুড়ের ব্যবসাটা আড়াই মাসের। তবে ভালো। গ্রাম থেকেই গুড় কিনি। আমার এলাকায় গুড়ের দাম কম। চুয়াডাঙ্গায় গুড়ের মানও ভালো। ভেজাল তেমন হয় না। আর ভেজাল হলেও হয়তো সর্বোচ্চ চিনি মেশায়।’

দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে শহরের ভাড়া বাসায় থাকছেন শারিফুল। তবে দুটো ব্যবসা করেও সংসার চালাতে তাঁকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। শহর ছেড়ে আবার গ্রামে ফেরার চেষ্টা করছেন তিনি।

একজন ক্রেতাকে গুড় মেপে দিয়ে পাশে থাকা গামছায় হাত মুছতে মুছতে শারিফুল বলছিলেন, ‘শহর আর ভালো লাগছে না। আয়ের সঙ্গে পেরে উঠছি না। এ বছরটা করে চুলের ব্যবসাটা ছেড়ে দেব। শহরে অনেক খরচ। বাসাভাড়া ছাড়া বিল তো আছেই। এরপর সবকিছু কিনে খাওয়া লাগে। একটা ইজিবাইক কিনে নিজের এলাকায় চলে যাব। এলাকায় থাকা শান্তি আছে। বাসাভাড়াটাও লাগবে না। বাজারঘাট করা লাগবে না; শাকসবজি তুলে অন্তত খাওয়া যাবে।’