ভারত থেকে ফিরলেন রহমত, নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত পরিবার

রহমত উল্লাহ

র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নেওয়ার প্রায় ১৬ মাস পর পরিবারের সদস্যদের কাছে ফিরে এসেছেন ঢাকার ধামরাই উপজেলার বড়নালাই গ্রামের তরুণ রহমত উল্লাহ। গত রোববার দুপুরে পরিবারের কাছে ফিরলেও এখনো স্বাভাবিক হতে পারেননি তিনি। বাড়িতে চুপচাপ বসে থাকা রহমতের মানসিক অবস্থা নিয়ে চিন্তিত পরিবারের সদস্যরা। নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কার কথা জানিয়েছেন তাঁরা।

রহমত উল্লাহ কারও সঙ্গে তেমন কোনো কথা বলছেন না উল্লেখ করে তাঁর বড় ভাই মো. ওবায়দুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজ (সোমবার) সারা দিন ঘুমিয়েছে। চুপচাপ বসে থাকে। মা ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেছেন। আমরা সবাই ভাবছি, তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাব। এ ছাড়া তার নিরাপত্তা নিয়েও পরিবারের সবাই চিন্তিত।’ তিনি বলেন, ‘দুপুরে ধামরাই থানার ওসি এসেছিলেন। তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। আমাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছেন।’

গত বছরের ২৯ আগস্ট রাতে র‌্যাব পরিচয়ে একটি দল রহমত উল্লাহকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। এর পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন তিনি। প্রায় ১৬ মাস পর রোববার দুপুরের দিকে বাড়িতে পৌঁছান রহমত উল্লাহ (২১)। ছেলেকে জীবিত ফিরে পাবেন কি না, সেটি জানা ছিল না মা মমতাজ বেগমের। ছেলেকে কাছে পেয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমার ছেলের আট দিন জ্বর আছাল (ছিল)। আমার কাছেই শুয়া আছাল, র‌্যাব আর সাদাপোশাকে মানুষ ঘরে আইসা ধইরা নিয়া গেছিল। তারা কইছিল জিজ্ঞাসাবাদ কইরা ছাইড়া দিমু। র‌্যাব অফিসে, ডিবি অফিসে, পুলিশের কাছে গেছি কতবার, কোনো খোঁজ পাই নাই। আমার বাবারে এখন ফিরা পাইছি।’

ধামরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, রহমত উল্লাহর বাড়িতে গিয়ে তাঁর পরিবারের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা হয়েছে। তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। রহমত উল্লাহর শারীরিক ও মানসিক দিক বিবেচনা করে তাঁকে এ মুহূর্তে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করা উচিত বলে মনে হয়নি।

আজ (সোমবার) সারা দিন ঘুমিয়েছে। চুপচাপ বসে থাকে। মা ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেছেন। আমরা সবাই ভাবছি, তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাব। এ ছাড়া তার নিরাপত্তা নিয়েও পরিবারের সবাই চিন্তিত।
বড় ভাই মো. ওবায়দুল্লাহ

যেভাবে পরিবারের কাছে রহমত

পরিবারের সদস্যরা জানান, শনিবার (২১ ডিসেম্বর) দুপুরে অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন পান রহমত উল্লাহর বড় ভাই মো. ওবায়দুল্লাহ। অপর প্রান্তের ব্যক্তি নিজেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর থানার রহনপুর পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের এসআই (উপপরিদর্শক) মো. ফজলে বারী পরিচয় দিয়ে রহমত উল্লাহকে পাওয়ার কথা জানান। ওবায়দুল্লাহ খোঁজ নিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত হন।

মো. ওবায়দুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসআই মো. ফজলে বারীর কল পেয়ে আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে রহমত উল্লাহকে নিয়ে বাসায় আসি। শুরুতে রহমত উল্লাহ আমাকে চিনতে পারছিল না। খুব বেশি কথা বলতেছে না।’

বাড়িতে ফিরেও অনেকটাই চুপচাপ রহমত উল্লাহ। রোববার রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারতের জেল থিকা বাইর করছে, তারপর বাংলাদেশে নিয়া আসছে। আজকে (রোববার) বাড়ি আসছি।’

আমার ছেলের আট দিন জ্বর আছাল (ছিল)। আমার কাছেই শুয়া আছাল, র‌্যাব আর সাদাপোশাকে মানুষ ঘরে আইসা ধইরা নিয়া গেছিল। তারা কইছিল জিজ্ঞাসাবাদ কইরা ছাইড়া দিমু। র‌্যাব অফিসে, ডিবি অফিসে, পুলিশের কাছে গেছি কতবার, কোনো খোঁজ পাই নাই। আমার বাবারে এখন ফিরা পাইছি।
মা মমতাজ বেগম

রহমত উল্লাহর বরাতে যা জানায় পুলিশ

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর থানার পুলিশ জানায়, থানায় আসার পর রহমত উল্লাহ তাদের জানিয়েছেন, গত বছরের ২৯ আগস্ট নিজ বাড়ি থেকে র‌্যাব তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। এরপর ঢাকায় ৯ মাস চোখ, হাত-পা বেঁধে আটকে রাখা হয়। যেখানে তাঁকে রাখা হয়েছিল, এর আশপাশে বিমান ওঠানামা করত। শুধু খাওয়ার সময় চোখ খোলা রাখা হতো। খাওয়া শেষ হলে আবার তাঁর চোখ বেঁধে ফেলা হতো। এভাবে ৯ মাসের মতো রাখার পর গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন হাইয়েস গাড়িতে করে তাঁকে যশোরের বেনাপোল সীমান্তে নিয়ে যান। সীমান্ত পার করে রহমত উল্লাহকে ভারতের সীমানায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। দু-তিন দিন ভারতে ঘুরার পর ভারতের পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

রহমত উল্লাহ পুলিশকে জানিয়েছেন, অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে ভারতে তাঁকে একটি জেলে রাখা হয়। সেখানে ছয় মাসের সাজা হয়। এ ছাড়া ১ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ২ মাস জেল খাটতে হবে—এমন সাজা হয়। ৭ মাস জেল খাটার পর সর্বশেষ দমদম জেলখানা থেকে গাড়িতে করে সীমান্তে আনা হয়। গত শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে তাঁকে বাংলাদেশে ‘পুশ ব্যাক’ করা হয়।

রহমত উল্লাহকে জিজ্ঞাসাবাদকারী রহনপুর তদন্তকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত ইনচার্জ মো. ফজলে বারী প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমে রহমত উল্লাহ সন্দেহ করছিলেন, পুলিশ তাঁকে মেরে ফেলতে পারে। তবে পরে কিছুটা স্বাভাবিক হলে তাঁর কাছ থেকে পরিবারের তথ্য নিয়ে ধামরাই থানা-পুলিশের সহযোগিতায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।

মো. ফজলে বারী বলেন, ‘তাকে (রহমত উল্লাহকে) জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমাকে ধরল কেন? সে উত্তরে বলেছিল, ‘‘তারা বলছে (র‍্যাব) আমি নাকি জঙ্গি করি।” তখন সিডিএমএস (সফটওয়্যার ক্রাইম ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) সার্চ করে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা পাইনি।’

গোমস্তাপুর থানার ওসি খাইরুল বাসার বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে রহমত উল্লাহ জানিয়েছেন, ৯ মাস তাঁকে দেশেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করে রেখেছিল। এরপর যশোর সীমান্ত এলাকায় মোটরসাইকেলওয়ালা দুজন লোকের কাছে দেওয়া হয়। পরে তারা ভারতে নিয়ে যায়। পাসপোর্ট ছাড়া ভারতে যাওয়ায় ভারতের পুলিশ মামলা দিলে সাত মাস জেল খেটেছেন। শুক্রবার গভীর রাতে নৌকা করে রহমত উল্লাহকে নদী পার করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। পরে তিনি গোমস্তাপুর থানার আসেন।

অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ৭২১ জন গুমের শিকার হয়েছিলেন। এর মধ্যে ১৫৮ জনকে এখন পর্যন্ত ফেরত পাওয়া যায়নি। প্রকৃত গুমের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। অধিকার মনে করে, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারতের কারাগারে বন্দী সব বাংলাদেশির তথ্য যাচাই করা প্রয়োজন।

আরও মানুষ ভারতে বন্দী, ধারণা অধিকারের

রহমত উল্লাহ ভারত থেকে ফিরে আসায় গুমের শিকার আরও মানুষ ভারতে বন্দী আছেন বলে ধারণা করছে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ২০১২ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকার আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল চত্বর থেকে ডিবি পুলিশ দ্বারা অপহৃত হন সুখরঞ্জন বালি। পরবর্তী সময়ে তাঁকে ভারতের দমদম কারাগারে পাওয়া যায়। এ ছাড়া বিএনপির নেতা সালাহ উদ্দিন আহমদ ২০১৫ সালের ১০ মার্চ ঢাকা থেকে গুম হন। পরে ওই বছরের ১১ মে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ে তাঁর আটকের খবর পাওয়া যায়। অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ৭২১ জন গুমের শিকার হয়েছিলেন। এর মধ্যে ১৫৮ জনকে এখন পর্যন্ত ফেরত পাওয়া যায়নি। প্রকৃত গুমের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। অধিকার মনে করে, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারতের কারাগারে বন্দী সব বাংলাদেশির তথ্য যাচাই করা প্রয়োজন।