নদীতে নদীতে ‘হরিণার ছাও’ ধরে চলে জীবন
লবণপানির চিংড়িঘেরে মাসিক চুক্তিতে শ্রমিকের কাজ করতেন মোজাফফর শেখ। খুলনার দাকোপের বিভিন্ন এলাকার ঘের ছিল তাঁর কাজের জায়গা। বছর বিশেক আগ থেকে ওই এলাকায় লবণপানিতে চিংড়ি চাষের ঘেরগুলো বন্ধ হওয়া শুরু করে। লবণের প্রভাব কাটিয়ে এলাকায় আবার সবুজ ফিরতে থাকে। তবে ঘের বন্ধ হওয়ায় সাময়িক কর্মহীন হয়ে পড়েন মোজাফফর।
মোজাফফরের জীবিকা এখনো লবণপানিতেই। ঘেরের বদ্ধ লবণপানির শ্রমিকের জীবন ছেড়ে নদীর মুক্ত লবণপানিতে স্বাধীনভাবে পোনা সংগ্রহ করেন তিনি। তাঁর বাড়ি খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার সুরখালী বারোভূঁইয়া গ্রামে। ষাটোর্ধ্ব মোজাফফর ১৮ বছর ধরে বিভিন্ন নদীতে হরিণা চিংড়ির পোনা সংগ্রহের কাজ করছেন।
সম্প্রতি কাঁধে জাল, ঝুড়ি, লাঠি নিয়ে বটিয়াঘাটার খড়িয়া এলাকায় খুলনা-চালনা সড়কের পাশে দেখা হয় মোজাফফরের সঙ্গে। সঙ্গী ভাতিজা বাবুল শেখ। তাঁদের উদ্দেশ্য, সড়কের পাশের কাজিবাছা নদীর চর থেকে হরিণার পোনা সংগ্রহ করা। মোজাফফর-বাবুল জোট বেঁধে পোনা ধরেন। জোয়ার একটু গভীর হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন দুজন। নদীর পাড়ে বসে পোশাক বদলে পোনা ধরার উপযোগী পোশাক পরেন দুজন। শুকনা কাপড়গুলো মাথায় বেঁধে রাখেন। এটাই তাঁদের কাজের পদ্ধতি।
সেখানে কথা হয় তাঁদের সঙ্গে। কথায় কথায় মোজাফফর বলেন, ছয় ভাইয়ের বড় সংসারে ছোটবেলা থেকেই অভাব-অনটন। বাবার শুধু ছোট একটা ভিটে ছিল। খুব ছোট থেকেই মানুষের বাড়ি কাজ করেন। এলাকায় চিংড়ি চাষ শুরু হলে মানুষের ঘেরে থাকতেন। মাসে ৮০০ থেকে হাজার টাকা পেতেন। লোনাপানির ঘের বন্ধ হয়ে গেল। আয়ের পথ নেই। বেঁচে তো থাকতে হবে! সেই থেকে ‘হরিণার ছাও’ ধরে সংসার চলে তাঁর।
এদিকে নয় ভাইবোনের সংসারে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন বাবুল শেখ। মাঙ্গা নদীর ভাঙনে তাঁদের ১১ বিঘা জমি নদীগর্ভে চলে যায়। এরপর পড়ালেখাটা আর হয়নি। খেত-খামারে কাজ করতে থাকেন বাবুল। পরে চাচা মোজাফফরের দেখাদেখি তিনিও ১৩ থেকে ১৪ বছর ধরে এই পেশায় আছেন।
শীতকালসহ ১২ মাস হরিণার পোনা ধরেন চাচা-ভাতিজা। সারা বছরই কম-বেশি পোনা ধরা পড়ে, তবে মূল মৌসুম শুরু হয় বৈশাখের শেষ দিক থেকে শ্রাবণের শেষ পর্যন্ত। অন্য সময় যে পরিমাণ পোনা ধরা পড়ে, মৌসুমে তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ পোনা আহরণ করতে পারেন তাঁরা। আবার তিথির ওপর নির্ভর করেও পোনা কম-বেশি হয়। একাদশী থেকে পঞ্চমী তিথি পর্যন্ত পোনা বেশি ধরা পড়ে। নদী থেকে এসব পোনা ধরে আশপাশের বিভিন্ন ঘের ও পুকুর মালিকদের কাছে বিক্রি করেন তাঁরা। প্রতি কেজিতে ৬ থেকে ১০ হাজার হরিণার পোনা থাকে। ১ কেজি হরিণা পোনার দাম রাখেন ৬০০ টাকা।
বাবুল শেখ বলেন, ‘আমাদের জোয়ার নিয়ে চলতে হয়। দিনে দুবার জোয়ার-ভাটা। জোয়ার শেষের ঘণ্টাখানেক আগে থেকে চরের ওপর পানি উঠলে কাজ শুরু হয়। আমরা নদীতে নামি না, চরে ঘাসবনের মধ্যে হরিণা ধরি। আধা কেজি, কখনো এক কেজি পর্যন্ত পোনা ধরা যায়। নদীতে যখন নামব, কিছু না কিছু আসবেই। হরিণার বাচ্চার পাশাপাশি অন্য প্রজাতির চিংড়ি ও ছোট মাছও ধরা পড়ে। তাতে নিজেদের খাওয়ার মাছ হয়ে যায়।’
আলাপে আলাপে জানা গেল, মোজাফফর ও বাবুল খুলনা, বটিয়াঘাটা, দাকোপ, রামপাল, মোংলা এলাকার বিভিন্ন নদীতে পোনা ধরেন। তাঁদের বারোভূঁইয়া গ্রামের কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০টি পরিবার হরিণার পোনা ধরার পেশার সঙ্গে জড়িত। পোনা ধরার এ কাজ একা করা গেলেও সাধারণত সবাই জোটবদ্ধ হয়ে করে থাকেন। দুজন মিলে যে পোনা পান, তা একসঙ্গে করে বিক্রির পর টাকা সমান ভাগ করে নেন তাঁরা। ১৩ বছর ধরে মোজাফফর ও বাবুল একসঙ্গে থেকে পোনা ধরার কাজ করছেন।
কথার ফাঁকে মোজাফফর বলেন, ‘একা একা পোনা ধরা যায়। তবে দুজন মিলে করলে খরচ কমে, সুবিধা হয়। নদীতে ও চরে সাপ, কুমির, কামট (হাঙর), কাঁটা, হাড়গোড় থাকে। দুজন থাকলে ভয় কম লাগে।’
হরিণার পোনা ধরার জালটা বিশেষ ধরনের। বাঁশের ছোট তিনটা টুকরা আর বিশেষ সুতা দিয়ে তৈরি ত্রিভুজ আকৃতির জালটা তাদের কাছে ‘তেকাঠে’ জাল নামে পরিচিত। জালের সঙ্গে প্রত্যেকে একটা ঝুড়ি রাখেন পোনা রাখার জন্য। জাল বাঁধা ঝুড়ি পানিতে ভাসিয়ে রাখার জন্য প্লাস্টিকের বোতল বাঁধা আছে।
বাবুল শেখ বলেন, ‘হরিণা চিংড়ির প্রাণ কই মাছের মতো শক্ত। সহজে মরে না। মাছ জ্যান্ত রাখার জন্য পানিতে ভাসা ঝুড়ি ব্যবহার করি। তা ছাড়া ডাঙায় উঠালেও হরিণা তিন-চার ঘণ্টা বেঁচে থাকে।’
হরিণার পোনা ধরে সংসারে সচ্ছলতা এসেছে বাবুল-মোজাফফরের। সংসারের ব্যয় নির্বাহের পাশাপাশি কিছুটা সঞ্চয়ও করতে পারছেন। বাবুল শেখ বলছিলেন, ‘কাজটা পরিশ্রমের, তবে স্বাধীনতা আছে। সচ্ছল আছি। ৩০০ টাকা আয় করলে ২০০ টাকা খরচ হলেও ১০০ টাকা রাখা যায়।’