ব্রহ্মপুত্রের পানিতে যাচ্ছে ২৭৬৩ কোটি টাকা, একদিকে খনন অন্যদিকে ভরাট
২,৭৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের খননকাজ চলছে। সুফল পাওয়া নিয়ে সন্দেহ। প্রতিবেদন করেছেন কামরান পারভেজ, ময়মনসিংহ আব্দুল আজিজ, জামালপুর শাহাবুল শাহীন, গাইবান্ধা তাফসিলুল আজিজ, কিশোরগঞ্জ
জামালপুর শহরের পুরাতন ফেরিঘাট এলাকায় মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি গত শনিবার বেলা দুইটার দিকে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ পার হচ্ছিলেন। নৌকায় নয়, হেঁটে। নদের মাঝখানে হাঁটুপানি। তাই পার হতে তাঁর কোনো অসুবিধাই হচ্ছিল না।
অথচ ব্রহ্মপুত্র নদের এই জায়গা গত বছরই খনন করা হয়। সরকারি প্রকল্পে ব্যয় হয় বিপুল অর্থ। কিন্তু খনন করার পর নদটি আবার প্রায় আগের মতো ভরাট হয়ে গেছে।
ফেরিঘাটে পাওয়া গেল স্থানীয় বাসিন্দা বিল্লাল হোসেনকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, খননের নামে বালুর ব্যবসা হয়েছে। পরিকল্পিত খনন হয়নি। নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে কাজ হয়নি। তাঁর প্রশ্ন, যদি তা–ই হতো, এক বছরের ব্যবধানে নদের এই অবস্থা কেন?
অনেক ক্ষেত্রে খননের পর বালু ফেলা হয়েছে নদের চরে অথবা তীরে। বর্ষায় সেই বালু আবার নদীতে মিশে নদটি ভরাট হয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় বিপুল পরিমাণ বালু নদের তীরে রাখা আছে। আগামী বর্ষায় পানি এলে তার একাংশ নদে গিয়ে ভরাট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ২ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের খননকাজ করছে। গাইবান্ধা, জামালপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর ও কিশোরগঞ্জ—এই পাঁচ জেলায় নদের ২২৭ কিলোমিটার অংশ খনন করার কথা। কোনো কোনো এলাকায় খনন শেষ, কোনো কোনো এলাকায় কাজ চলছে, কোনো কোনো এলাকায় কাজ শুরু হয়নি। তবে গত কয়েক বছরে যেসব এলাকায় খনন হয়েছে, সেসব এলাকার মানুষ হতাশ। তাঁরা বলছেন, খনন করে কোনো লাভ হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে খননের পর বালু ফেলা হয়েছে নদের চরে অথবা তীরে। বর্ষায় সেই বালু আবার নদীতে মিশে নদটি ভরাট হয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় বিপুল পরিমাণ বালু নদের তীরে রাখা আছে। আগামী বর্ষায় পানি এলে তার একাংশ নদে গিয়ে ভরাট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
সব মিলিয়ে বিপুল অর্থ ব্যয়ের সুফল পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এ কারণে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ। গত বছরের মে মাসে ময়মনসিংহে তরুণেরা খনন হওয়া ব্রহ্মপুত্র নদের হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে ‘মৃতের চিৎকার’ শিরোনামে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেন। প্রতিবাদ জানানোই ছিল এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য।
জামালপুরের মানুষও হতাশ। যেমন জামালপুর পৌরসভার প্যানেল মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মো. ফজলুল হক আকন্দের বাড়ি জামালপুর পৌর শহরের ছনকান্দা এলাকায়। তাঁর বাড়ির কাছ দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদটি প্রবাহিত হয়েছে। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই বছর ধরে নদটি খনন করা হচ্ছে। কিন্তু নদের কোনো পরিবর্তন নাই। এক পাশ দিয়ে খনন করা হচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যে নদটি আবার আগের মতো হয়ে যাচ্ছে। ফলে খননের সুফল দেখছি না।’
খননের নামে বালুর ব্যবসা হয়েছে। পরিকল্পিত খনন হয়নি। নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে কাজ হয়নি। তাঁর প্রশ্ন, যদি তা–ই হতো, এক বছরের ব্যবধানে নদের এই অবস্থা কেন?স্থানীয় বাসিন্দা বিল্লাল হোসেন
ব্রহ্মপুত্র এখন
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮৩ কিলোমিটার। প্রস্থ ২০০ মিটার।
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদটি গাইবান্ধা, জামালপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর ও কিশোরগঞ্জ জেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এককালের প্রমত্ত ব্রহ্মপুত্র এখন স্রোত ও নাব্যতাহীন। এ কারণে ২০১৮ সালে ধরলা, তুলাই ও পুনর্ভবা নদীর সঙ্গে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদটি খননের জন্য ৪ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প নেয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এর বড় অংশ ব্যয় (২ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা) হবে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র খননে।
বিআইডব্লিউটিএর প্রকল্পে বলা হয়েছে, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ খননের উদ্দেশ্য হলো নাব্যতা ফিরিয়ে এনে সারা বছর যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী নৌযান চলাচল নিশ্চিত করা, যেন শুকনো মৌসুমেও ৯০ মিটার প্রস্থে ৮ থেকে ১০ ফুট গভীর পানি থাকে। ফলে এটি দ্বিতীয় শ্রেণির নৌপথে উন্নীত হবে। কৃষিকাজে পানি সরবরাহ করাও এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। উল্লেখ্য, ১২ ফুট গভীরতার নৌপথকে প্রথম শ্রেণি ও ৮ থেকে ১০ ফুট গভীরতার নৌপথকে দ্বিতীয় শ্রেণির নৌপথ বলে।
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদটি গাইবান্ধা, জামালপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর ও কিশোরগঞ্জ জেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এককালের প্রমত্ত ব্রহ্মপুত্র এখন স্রোত ও নাব্যতাহীন।
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র খনন শুরু হয় ২০১৯ সালের জুন থেকে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা আগামী জুনে। বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানিয়েছে, কাজ তেমন একটা এগোয়নি (গত জুন পর্যন্ত ৩৫ শতাংশ)। এ কারণে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএর প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) রকিবুল ইসলাম তালুকদার গতকাল রোববার তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, নদটি খননে একই সময়ে ১০০টি খননযন্ত্র বা ড্রেজার দরকার। কাজ করছে ৪৫টি। বরাদ্দ দরকার বছরে ৮০০ কোটি টাকা। পাওয়া গেছে পাঁচ বছরে ৮০০ কোটি টাকা। তিনি বলেন, ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি হলো নদীর তীর থেকে এক কিলোমিটার দূরে বালু ফেলবে। তা না হলে তাদের টাকা দেওয়া হবে না। তবে বালু ফেলার জন্য জায়গা পাওয়া যায় না।
রকিবুল ইসলাম তালুকদার আরও বলেন, গাইবান্ধার ফুলছড়ি ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্র যমুনার সঙ্গে মিলেছে। সেখানে খনন করা হলে পানি আসবে। তবে দুই দফা প্রশাসনের লোকজন নিয়ে সেখানে খনন করতে গিয়ে বাধার মুখে ফিরে আসতে হয়েছে।
বাধা দেওয়ার বিষয়টি জানতে গাইবান্ধার ফুলছড়ি ও জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরাবাদে খোঁজ নেওয়া হয়। তবে কেউ এ বিষয়ে জানাতে পারেননি। ফুলছড়ি উপজেলার চেয়ারম্যান সেলিম পারভেজ গত রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, মানুষ বাধা দেবে কেন, তারা চায় খনন হোক। কারণ, নদের নাব্যতা না থাকায় বৃষ্টি হলে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ির কাছে নদে একটি ড্রেজার দেখি। কাজ করতে দেখি না। নদ খননের নামে সরকারি টাকা লুটপাট চলছে।’
গাইবান্ধার ফুলছড়ি ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্র যমুনার সঙ্গে মিলেছে। সেখানে খনন করা হলে পানি আসবে। তবে দুই দফা প্রশাসনের লোকজন নিয়ে সেখানে খনন করতে গিয়ে বাধার মুখে ফিরে আসতে হয়েছে।বিআইডব্লিউটিএর প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) রকিবুল ইসলাম তালুকদার
নদের বালু নদে
খনন কেমন চলছে, তা দেখতে সম্প্রতি প্রথম আলোর চারজন প্রতিনিধি ময়মনসিংহ, জামালপুর, গাইবান্ধা ও কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় ব্রহ্মপুত্র নদ এলাকায় যান এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সাধারণ মানুষ ও নদ রক্ষায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁরা বলছেন, খনন করে বালু নদের পাড়ে রাখায় অনেক ক্ষেত্রে তা আবার নদে মিশেছে। যেসব জায়গায় বালু বিক্রির সুযোগ আছে, সেসব জায়গায় এলোমেলোভাবে নদটি খনন করা হয়েছে। কাজ চলছে খুব ধীরগতিতে। ফলে খনন না হওয়া জায়গার বালু এসে খনন হওয়া জায়গা ভরে যাচ্ছে।
যেমন গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের সাতারকান্দিতে প্রায় তিন মাস ধরে ব্রহ্মপুত্র নদে ড্রেজার মেশিন দিয়ে খননকাজ চলছে। গতকাল বেলা একটায় গিয়ে দেখা যায়, নদটি খনন করে বালু ফেলা হচ্ছে নতুন জেগে ওঠা একটি চরে। চরটি নদের মাঝে।
খননের কাজে নিয়োজিত একজন কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বালু দূরে ফেলার সুযোগ নেই। কেউ বালু ফেলতে জায়গা দেয় না।
ময়মনসিংহের গৌরীপুর ও ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের গ্রামগুলোতে দেখা যায়, নদে কোথাও পানি থাকলেও তার পাশেই আবার ছোট ছোট চর। অথচ ওই সব এলাকায় আগে খননকাজ করা হয়েছে। জেলার গফরগাঁও ও ত্রিশালে কাজ করছে বেঙ্গল গ্রুপের বেঙ্গল স্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এস এম রবিউল ইসলাম গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, নদের দুই পাড়ে মানুষ নিজের জমিতে তো বালু রাখতে দেয় না, খাসজমিতে রাখলেও বাধা দেয়। তিনি বলেন, ঠিকাদারদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। একজন ঠিকাদার যে জায়গায় খননকাজ শেষ করছেন, দেখা যায় তার একটু দূরে অন্য ঠিকাদার কাজ করেননি। তাতে বালু খনন হওয়া অংশে ছড়িয়ে পড়ে আবার ভরাট হয়ে যায়।
খননের বালু বিক্রি করে দেওয়ার কথা। বিক্রি ততটা হচ্ছে না। যেমন গত ২১ জানুয়ারি ময়মনসিংহের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার (রাজস্ব) দিলরুবা ইসলামের কার্যালয় থেকে জানা যায়, জেলায় এ পর্যন্ত খনন থেকে পাওয়া ৭ কোটি ৫৪ লাখ ঘনফুট বালু নিলামে বিক্রি করা হয়েছে। অবিক্রীত অন্তত ১৪০ কোটি ঘনফুট বালু। এ ছাড়া অনেক অবিক্রীত বালুর স্তূপের এখনো পরিমাপ করা হয়নি।
নদপারের বাসিন্দাদের আশঙ্কা, আসছে বর্ষা মৌসুমেই পাড়ে রাখা বালুর একাংশ আবার নদে চলে যাবে। গাইবান্ধার ফুলছড়ির সংস্কৃতিকর্মী ও নদপারের বাসিন্দা ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলছিলেন, যেভাবে খনন করে বালু নদের পাড়ে রাখা হয়, তা আগামী বর্ষায় আবার নদীতেই যাবে।
‘সুফল পাওয়া যাবে না’
আইএমইডি নদী খননে বিআইডব্লিউটিএর প্রকল্পটি নিয়ে গত জুনে একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে প্রকল্পের নানা দুর্বলতা তুলে ধরা হয়, যার একটি হলো, খননকাজ ঠিকভাবে হচ্ছে না। যেমন ময়মনসিংহের একটি এলাকায় পরিদর্শনকারী দলটি পানির গভীরতা পায় মাত্র সাড়ে চার ফুট, যদিও থাকার কথা ৮ থেকে ১০ ফুট। প্রতিবেদনে বলা হয়, নদে মূল (ক্যাপিটাল) ড্রেজিং করা হলেও রক্ষণাবেক্ষণ (মেইনট্যানেন্স) ড্রেজিংয়ের অভাব প্রকট। মূল ড্রেজিংয়ের পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং করা না হলে প্রকল্পের সুফল পাওয়া যাবে না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদী খননের কাজটি করতে হয় দ্রুত। যাতে একসঙ্গে খনন করে ফেলা যায়। কিন্তু ধীরে ধীরে অল্প অল্প করে কাজ করলে সুফল পাওয়া যায় না। টাকাগুলো পানিতে ঢালা হয়।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল বিআইডব্লিউটিএর অবসরপ্রাপ্ত একজন প্রকৌশলীর কাছে। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, দুই বছরের মধ্যে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র খনন করে ফেলতে পারলে নৌপথটি কাজে লাগানো যেত। এখন যে গতিতে প্রকল্প চলছে, তাতে মূল ড্রেজিংয়ের সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং না হলে দেখা যাবে, প্রকল্প শেষের পর নদী আগের মতো ভরাট হয়ে গেছে। তিনি বলেন, বিগত ১০ বছরে বেশ কিছু নদী খনন করা হয়েছে। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ না করায় সেগুলো আগের মতো নাব্যতা হারিয়েছে।