কাল শপথ চসিকের নতুন মেয়র শাহাদাতের, আছে আর্থিক দেনাসহ ছয় চ্যালেঞ্জ
আদালতের রায় নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়রের চেয়ারে বসতে যাচ্ছেন বিএনপির নেতা শাহাদাত হোসেন। তবে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগে পদে পদে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। তবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আর্থিক দেনা, সেবা কার্যক্রম সক্রিয় করা, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, জলাবদ্ধতা নিরসন, অনিয়ম বন্ধসহ ছয় চ্যালেঞ্জের সামনে পড়তে হবে তাঁকে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই নতুন মেয়রকে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
আগামীকাল রোববার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নতুন মেয়র শাহাদাত হোসেনকে শপথ পাঠ করানোর কথা রয়েছে।
গত ১ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেনকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে ঘোষণা করে রায় দিয়েছিলেন আদালত। রায় ঘোষণার সাত দিন পরই ৮ অক্টোবর শাহাদাত হোসেনকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা সংশোধিত প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন।
তবে মেয়র হিসেবে পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পাবেন না শাহাদাত হোসেন। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রজ্ঞাপন ও সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, শাহাদাত হোসেন সর্বোচ্চ ১৪ মাস দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। কেননা, সিটি করপোরেশনের ষষ্ঠ পরিষদের পাঁচ বছর মেয়াদ ২০২৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেষ হওয়ার কথা ছিল। এই পরিষদের নির্বাচিত মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের প্রথম সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয় ২০২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। সাধারণত প্রথম সাধারণ সভার দিন থেকে পরিষদের মেয়াদ গণনা করা হয়। যদি আগামী নির্বাচনে অংশ নেন, তাহলে এর আগেই পদত্যাগ করতে হবে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়রদের মধ্যে শাহাদাত হোসেন হলেন বিএনপির সমর্থিত দ্বিতীয় ব্যক্তি। এর আগে বিএনপির সমর্থনে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন মোহাম্মদ মনজুর আলম। আওয়ামী লীগ–সমর্থিত মেয়ররা হলেন এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, আ জ ম নাছির উদ্দীন ও মো. রেজাউল করিম চৌধুরী।
২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরী ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৪৮ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির শাহাদাত হোসেন ৫২ হাজার ৪৮৯ ভোট পান। ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে নয়জনকে বিবাদী করে মামলাটি করেছিলেন নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী নগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন।
কার্যক্রমে অচলাবস্থা
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের সরকারের পতন হয়। এর পর থেকে সিটি করপোরেশনে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন তৎকালীন মেয়র ও আওয়ামী লীগের নেতা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। আত্মগোপনে চলে যান ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। যদি পরে মেয়র ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের অপসারণ করে সরকার।
মেয়রকে অপসারণ করে প্রশাসক এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের জায়গায় সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এভাবে দায়িত্ব বণ্টন করা হলেও ৫ আগস্টের পর থেকে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমে অচলাবস্থা বিরাজ করছে, যা এখনো বিদ্যমান। এমনই জানিয়েছেন সিটি করপোরেশনের দুই কর্মকর্তা।
তাঁদের মতে, দায়িত্ব নেওয়ার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সিটি করপোরেশনের অচলাবস্থা নিরসন করে সেবা কার্যক্রম সচল করা। এর বাইরে সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করা, আর্থিক সংকট নিরসন, চলমান প্রকল্পের কাজ ঠিক সময়ে বাস্তবায়ন এবং বাস্তবায়নে স্বজন ও দলীয় প্রীতি বন্ধ করা হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়রদের মধ্যে শাহাদাত হোসেন হলেন বিএনপির সমর্থিত দ্বিতীয় ব্যক্তি। এর আগে বিএনপির সমর্থনে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন মোহাম্মদ মনজুর আলম। আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মেয়ররা হলেন এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, আ জ ম নাছির উদ্দীন ও মো. রেজাউল করিম চৌধুরী।
এ ছাড়া বিএনপির নেতা শাহাদাতের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নগরের দীর্ঘদিনের পুরোনো জলাবদ্ধতা সমস্যা সহনীয় করা এবং তিন সংস্থার চলমান চার প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নে সমন্বয় সাধন করা। ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। যন্ত্রপাতি, উপকরণ কেনাকাটায় অনিয়ম বন্ধ করা।
কাঁধে ৪১১ কোটি টাকার দেনা
সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব নিয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে দেনা পরিশোধ। বর্তমানে করপোরেশনের দেনার পরিমাণ ৪১১ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে উন্নয়নকাজের বিপরীতে ঠিকাদারদের পাওনা ২৬০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আনুতোষিক পাবেন ৬৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা। তাঁদের ভবিষ্য তহবিলের টাকা বাকি রয়েছে ৫৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা। সড়কবাতির বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের পরিমাণ ২৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
অতীতে দায়িত্ব পালন করা সিটি করপোরেশনের মেয়রদের কেউ আর্থিক শৃঙ্খলা নিয়ে সচেতন ছিলেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। এতে বছরের পর বছর উন্নয়নকাজের বকেয়া বিলের পরিমাণ বেড়েছে। এ ছাড়া অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিল বছরের পর বছর আটকে রাখা হতো। আবার তহবিল–সংকটও ছিল। ফলে অবসরের পর এই টাকা পেতে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে দেখা যায় তাঁদের। এই টাকা না পেয়ে অনেককে চিকিৎসার খরচ, ছেলেমেয়ের বিয়ের খরচসহ পারিবারিক খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হয়।
অপসারিত মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর আমলে সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক শৃঙ্খলা কার্যত ভেঙে পড়েছিল। ওই সময় কোনো ধরনের নিয়মনীতি না মেনে একের পর এক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সিটি করপোরেশনের শীর্ষ কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি ও চাকরি স্থায়ীকরণ নিয়ে বিভিন্ন ক্ষোভ রয়েছে। এগুলো সমন্বয় করতে হবে নতুন মেয়রকে।
ফেরাতে হবে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা
অপসারিত মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর আমলে সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক শৃঙ্খলা কার্যত ভেঙে পড়েছিল। ওই সময় কোনো ধরনের নিয়মনীতি না মেনে একের পর এক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অন্তত আড়াই শ অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়। সিটি করপোরেশনের মেয়র, ওয়ার্ড কাউন্সিলর, কর্মকর্তাদের আত্মীয়স্বজনেরা এসব নিয়োগে গুরুত্ব পেয়েছেন। তবে ঠিক কতজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান সিটি করপোরেশন কখনো প্রকাশ করেনি। এ ছাড়া পদোন্নতির ক্ষেত্রেও ঘটেছে অনিয়ম।
সিটি করপোরেশনের শীর্ষ কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এ নিয়ে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের অন্য সিটি করপোরেশনে বদলির ঘটনা ঘটেছে। আর অন্য সংস্থা থেকে প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা এনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদায়ন করা হয়েছে।
এ ছাড়া সিটি করপোরেশনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি ও চাকরি স্থায়ীকরণ নিয়ে বিভিন্ন ক্ষোভ রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন হাটবাজার, ঘাট ও কাজ নেওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। সিটি করপোরেশনের অভ্যন্তরেও পদপদবির দায়িত্ব নিয়ে বিএনপিপন্থীদের ক্ষোভ রয়েছে। এগুলো সমন্বয় করতে হবে নতুন মেয়রকে।
দায়িত্ব পালনে নানা চ্যালেঞ্জ থাকলেও তা নিয়ে খুব একটা বিচলিত নন চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রাম নগর নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা আছে। যেটুকু সময় পাবেন, সে সময়ে জলাবদ্ধতা সমস্যাকে অগ্রাধিকার দেবেন। নাগরিক দুর্ভোগ দূর করতে কাজ করবেন। গুরুত্ব দেবেন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বিষয়েও। একটি বাসযোগ্য নগর হিসেবে চট্টগ্রামকে গড়ে তোলার বিষয়ে মনোনিবেশ করবেন। ক্লিন, গ্রিন ও হেলদি সিটি হিসেবে গড়ে তুলবেন।