৬০ বছর ধরে বাঁশি বাজান আবদুল্লাহ, পূরণ হয়নি বেতার-টিভিতে বাজানোর স্বপ্ন
কপাল আর গালে বয়সের ছাপ। সামনের সারির কয়েক জোড়া দাঁত হারিয়েছেন বেশ আগেই। ফোকলা দাঁতের ফাঁক দিয়ে বের হওয়া বাতাস দিয়েই বাঁশিতে তোলেন সুর। এই বংশীবাদক হলেন দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামের মো. আবদুল্লাহ (৭২)।
বিখ্যাত শিল্পীদের গানের সুর বাঁশিতে তুলে আবদুল্লাহ পার করেছেন ছয় দশক। বাঁশির সুরে মুগ্ধ হওয়া শ্রোতাদের বাহবা, করতালি আর শুভেচ্ছায় সিক্ত হয়েছেন অসংখ্যবার। তবে দেশের বেতার ও টেলিভিশনে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বাঁশিতে সুর তোলার স্বপ্নটা এখনো পূরণ হলো না বংশীবাদক আবদুল্লাহর।
স্ত্রী, দুই ছেলে, ছেলের বউ ও নাতি-নাতনি নিয়ে আবদুল্লাহর সংসার। তিনি বলেন, তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের নানা জায়গায় বাঁশি বাজিয়েছেন। ভারতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করার সুবাদে শাস্ত্রীয় সংগীতসহ সব ধরনের গানের সুর বাঁশিতে তোলার কলাকৌশল রপ্ত করেছেন তিনি। সংস্কৃতির জগৎ থেকে যেন বাঁশির সুর হারিয়ে না যায়, সে জন্য নানা জায়গার পাঁচ শতাধিক মানুষকে বাঁশি বাজানো শিখিয়েছেন।
ছোটবেলায় বাঁশির প্রেমে পড়ার স্মৃতিচারণা করে আবদুল্লাহ বলেন, অভাবের সংসারে দুমুঠো ভাতের জন্য তিনি মাঠে রাখালের কাজ করতেন। একই মাঠে গরু চরানোর কাজ করতেন তাঁর গ্রামের রাখাল গোপাল রায়। তিনি খুব সুন্দর বাঁশি বাজাতেন। ওই রাখালের পাশে বসে বাঁশির সুর শুনতেন তিনি। একদিন ওই রাখালের কাছ থেকে বাঁশিটি তিনি নিজের হাতে তুলে নেন। সুর তোলার চেষ্টা করেন। এরপর বাজার থেকে বাঁশি কিনে নিয়ে তিনি গোপালের কাছে বাঁশি বাজানো শেখেন। সেই থেকে আবদুল্লাহর বাঁশির সুর আর থামেনি।
যুবক বয়সে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজাতে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে গেছেন আবদুল্লাহ। সেই আয়ের টাকায় সংসার চালিয়েছেন। নানা আধুনিক যন্ত্র এসেছে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও কমেছে। এখন আর বাঁশি বাজানোর জন্য ডাক পান না তিনি। বাঁশি বাজানোর পাশাপাশি তিনি বাঁশের বাঁশি তৈরিতেও বেশ দক্ষ। তিনি নিজের হাতে তৈরি করা বাঁশি এখন বিভিন্ন মেলায় বিক্রি করেন। এলাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠান আর মেলায় অল্পবিস্তর বাঁশি বাজান। জীবিকার প্রয়োজনে কাঁধে বাঁশিভর্তি ব্যাগ নিয়ে প্রতিদিন পথে পথে ঘুরে বেড়ান। ছোট বাঁশি ৫০ টাকা আর বড় বাঁশি ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি করেন। এ আয়েই চলে তাঁর সংসার।
আবদুল্লাহর স্বপ্ন বেতার ও টেলিভিশনে বাঁশি বাজানোর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার এ স্বপ্নের জন্য এত দিন ধরে সাধনা করলাম। কিন্তু টিভিতে বা রেডিও সেন্টারে আমি চান্স পেলাম না। আমি তো যেকোনো সুর বাজাই। আজ পর্যন্ত আমি সরকারের কোনো অনুদান পাইনি। কেউ যদি আগ্রহ করে আমাকে টিভিতে বা কোনো চ্যানেলে নিয়ে থাকেন, তাহলে আমার স্বপ্নটা পূরণ হবে। আমার খুব ভালো লাগবে।’
নবাবগঞ্জ উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সুলতান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, বংশীবাদক আবদুল্লাহ অত্যন্ত গুণী। বেতার ও টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজানোর সব ধরনের যোগ্যতা ও দক্ষতা তাঁর আছে। তবে তিনি তৃণমূল পর্যায়ে বেশি কাজ করেন বলে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর এত দিন তাঁর গুণের কদর করেনি। একাধিকবার আবেদন করা হয়েছে, সেই আবেদন আলোর মুখ দেখেনি।
এ বিষয়ে দিনাজপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমির জেলা কালচারাল অফিসার মীন আরা পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নবাবগঞ্জ উপজেলায় আবদুল্লাহর মতো এমন একজন গুণী ও প্রবীণ শিল্পী আছেন, তা আমার জানা ছিল না। তিনি বেতার ও টেলিভিশনে শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য আবেদন করলে জেলা শিল্পকলা একাডেমি থেকে সুপারিশ করা হবে।’