রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের অভাবে ‘অচলাবস্থা’
তন্ময় ইসলাম ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) ভর্তি হয়েছিলেন। এ মাসে চূড়ান্ত সেমিস্টারের পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। সেই পরীক্ষা হচ্ছে না। গত জানুয়ারিতে আগের সেমিস্টারের পরীক্ষা দিলেও এখনো ফলাফল প্রকাশিত হয়নি। তন্ময় বলেন, করোনার কারণে এমনিতেই তাঁদের শিক্ষাজীবন দীর্ঘ হয়ে গেছে; পরীক্ষা ও ফলাফলের জন্য বারবার শিক্ষকদের তাগাদা দিচ্ছেন। কিন্তু শিক্ষকেরা বলছেন, উপাচার্য নেই। এতে তাঁরা খুব হতাশার মধ্যে আছেন।
২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘১৭ সিরিজ’ বলা হয়। এই সিরিজের মতো অন্যান্য সিরিজের শিক্ষার্থীরাও দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। ওই সব সিরিজের ক্লাসও শেষের দিকে। তাঁদের পরীক্ষা আগামী মাসে কিংবা তার পরের মাসে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য না থাকায় সেই পরীক্ষা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। আটকে আছে আগে দেওয়ার পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশও।
শুধু শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা-ফলাফলই নয়, আটকে আছে অনেক শিক্ষকের পদোন্নতি ও বিদেশযাত্রা। অর্থ ছাড় হচ্ছে না বলে অনেক বিভাগে একাডেমিক সরঞ্জামও কেনা যাচ্ছে না। নাম প্রকাশ না করে একটি বিভাগের সভাপতি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা প্রতিদিনই জিজ্ঞাসা করছে, ‘পরীক্ষা হবে তো?’ তাদের আর কী বলব। তাদের বলি যে বিভাগের প্রিন্টারের কার্টেজ কেনার টাকাও নেই।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) মো. সেলিম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, উপাচার্য না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে একরকম অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাঁরা গত ১৮ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি অবগত করেছেন। এমনও চেয়েছেন, উপাচার্য নিয়োগের আগে অন্তত এমন কাউকে দেওয়া হোক, যিনি কাজটা চালিয়ে নিতে পারেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের জুলাইয়ের শেষে নিয়মিত উপাচার্য রফিকুল ইসলামের মেয়াদ শেষ হয়। পরে ৩ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে রুয়েটের জ্যেষ্ঠতম অধ্যাপক ও অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ অনুষদের ডিন মো. সাজ্জাদ হোসেনকে উপাচার্যের দৈনন্দিন কার্যসম্পাদনের দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়। তবে গত ২৮ মে পদোন্নতির দাবিতে শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন তিনি। এর পর থেকে একাডেমিক পরীক্ষা ও ফলাফল প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়।
১৭ সিরিজের এক শিক্ষার্থী নগরের কাজলা এলাকায় থাকেন। তাঁদের বিভাগের ক্লাস শেষ হয়ে গেছে। এখন শুধু পরীক্ষাটা দিলেই চলে যেতে পারেন। নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেন, পরিবারকে এখন কিছু দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরিবারের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। পরীক্ষাটা দ্রুত হয়ে গেলে কোনো একটা চাকরির খোঁজ করতে পারতেন। চাকরির পরীক্ষায় অংশ নিতে পারতেন। এ পরিস্থিতিতে চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতিও নিতে পারছেন না।
১৯ সিরিজের শিক্ষার্থী জয় চৌধুরী বলেন, তাঁদের বিভাগের ক্লাস শেষের দিকে। পরীক্ষার তারিখ সামনেই। এখন যদি উপাচার্য না নিয়োগ দেওয়া হয়, তাঁরাও বিপদে পড়বেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা গ্রহণের জন্য নানা রকম কমিটি গঠন করতে হয়। এ জন্য উপাচার্যের অনুমোদনের দরকার হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. তৌহিদ আরিফ খান চৌধুরী ১১ জুলাই বিভাগগুলোকে চিঠি দিয়ে পরীক্ষা নিতে না পারার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, পরীক্ষার বিধি অনুযায়ী পেপার সেটারের (প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটি নিয়োগ) একমাত্র ক্ষমতা উপাচার্যের। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদটি শূন্য থাকায় তাঁর অনুমোদিত পেপার সেটার ছাড়া সেমিস্টার পরীক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব নয়।
পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. তৌহিদ আরিফ খান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, রুয়েটের প্রায় সব বিভাগের পরীক্ষার ফলাফল আটকে আছে। ১৭ সিরিজের পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। সে পরীক্ষাও নেওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া অন্য বিভাগের পরীক্ষাগুলোও সামনের মাসে হওয়ার কথা আছে। সেগুলো নেওয়া নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী উপাচার্য ছাড়া এই কাজগুলোর অনুমোদন বিশ্ববিদ্যালয়ের আর কেউ পারেন না।
এদিকে ১৭ সিরিজের শিক্ষার্থীরা গতকাল সোমবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ডিনদের নিয়ে সভা করেছেন। সেখানে তাঁরা তাঁদের সমস্যার কথা বলেছেন। আজ মঙ্গলবার এ নিয়ে ডিনদের জরুরি সভা রয়েছে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ডিন মো. নিয়ামুল বারী বলেন, শিক্ষার্থীরা তাঁদের পরীক্ষা ও ফলাফলের বিষয়টি নিয়ে বসেছিলেন। সেখানে তাঁরা গিয়েছিলেন। উপাচার্য ছাড়া পরীক্ষা নেওয়া যাচ্ছে না। তবু মঙ্গলবার তাঁরা একটি জরুরি সভা ডেকেছেন। সেখানে আলোচনা করবেন।
রুয়েটের শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. ফারুক হোসেন বলেন, উচ্চশিক্ষা, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন কাজে ১১ জনের মতো শিক্ষকের বিদেশে যাওয়ার কথা ছিল। উপাচার্য না থাকায় অনাপত্তিপত্র (এনওসি) না পেয়ে তাঁরা বিদেশ যেতে পারছেন না। অনেকের ফ্লাইটও বাতিল হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরাও বিপদে পড়ে গেছেন। একমাত্র উপায় হচ্ছে দ্রুত উপাচার্য নিয়োগ।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) আবু ইউসুফ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, রুয়েটের বিষয়টি তারা অবগত। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এ ব্যাপারে একটি ফাইল গেছে।