আকাশছোঁয়া গর্জনের বন, মেধাকচ্ছপিয়ার বন্যতার হাতছানি

মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানের ফটকপ্রথম আলো

দুই পাশে গর্জনের সারি। বুক চিরে গেছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক। অন্তত ৫০০ মিটার এলাকায় হিমশীতল পরিবেশ। এলাকাটি পাড়ি দিতে দিতে কানে ভেসে আসে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির। ঘন গর্জনবনে ঢুকলে গা ছমছম করে।

কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী ইউনিয়নের মেধাকচ্ছপিয়া বনের সৌন্দর্য দেখা যায় মহাসড়ক থেকেই। এই বনকে সরকার ২০০৮ সালে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে। ৯৯০ একর বনভূমি নিয়ে এই উদ্যান তৈরি করা হয়। উদ্যানের ভেতরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষী আট হাজারের বেশি গর্জনগাছ।

মেধাকচ্ছপিয়া বনে যা দেখবেন

মেধাকচ্ছপিয়া ঢালা থেকে এই বনের শুরু। খুটাখালীর সেগুনবাগিচা এলাকায় মেধাকচ্ছপিয়া বন শেষ হয়েছে। পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনতে শুনতে বন্য প্রাণী দেখার সুযোগ রয়েছে। শতবর্ষী গর্জনগাছে ছাওয়া বনাঞ্চলের গভীর প্রশান্তিময় সৌন্দর্য পর্যটকদের প্রকৃতির আরও কাছে নিয়ে যায়। এই বনে গাছে ওঠার জন্য একাধিক সিঁড়ি নিয়ে তৈরি হয়েছে ট্রি অ্যাডভেঞ্চারও। চাইলে উঁচু গাছে চড়ে বনের শীর্ষভাগের আলো–হাওয়ার খেলা দেখতে পারেন পর্যটকেরা। এ ছাড়া গভীর বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে হাঁটাপথ। এই পথের মুখেই ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন একটি ফটক। ফটকের দুই পাশে দুটি হাতির ভাস্কর্যও বানানো হয়েছে।

বনে মাঝে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন হ্রদ
প্রথম আলো

বনের কৃত্রিম হ্রদ

কক্সবাজারে সমুদ্রস্নানের পাশাপাশি পর্যটকদের নিবিড় অরণ্যে অবসর কাটানোর সুযোগ করে দিতে মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানে তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম হ্রদসহ নানা অবকাঠামো। হ্রদের পাড়ে নির্মাণ করা হয়েছে একাধিক বিশ্রামাগার। ২০২৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবসে খুলে দেওয়া হয় এই হ্রদ। দৃষ্টিনন্দন এক কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই হ্রদ পর্যটনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। হ্রদের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের অবস্থান। উত্তর পাশে গর্জনবনের ভেতরে রয়েছে হেঁটে বেড়ানোর পথ ও ট্রি অ্যাডভেঞ্চারের ব্যবস্থা। প্রায় ৮৫ লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি হ্রদের পাড়ে পর্যটকের বসার জন্য বেঞ্চ, কিটকট (চেয়ার ও ছাতা) বসানো হয়েছে। ময়লা–আবর্জনা ফেলার জন্য বসানো হয়েছে একাধিক ডাস্টবিন। সকাল, দুপুর ও বিকেলে নির্জন হ্রদের পাড়ে বসে বনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন পর্যটকেরা।

আকাশ ছোঁয়া গর্জনের সারি মেধাকচ্ছপিয়ার সৌন্দর্য বাড়িয়েছে
প্রথম আলো

ট্রি অ্যাডভেঞ্চার

বন বিভাগের দাবি, এ অরণ্যেই দেশের প্রথম ইকো অ্যাডভেঞ্চার প্রতিষ্ঠা করেছে তারা। বন বিভাগের সহযোগিতায় ২০১৮ সালের ২৪ জানুয়ারি ট্রি অ্যাডভেঞ্চার চালু হয় আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএসএআইডির ক্রেল প্রকল্পের অধীনে। নির্জন বনের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে চোখে পড়বে বন্য হাতির পাল, মেছো বাঘ, বন্য শূকর, বানর, বনবিড়াল, খাটাশসহ নানা প্রজাতির বন্য প্রাণী। তবে তাতে দর্শনার্থীর বিপদের আশঙ্কা নেই বললেই চলে। বিরক্ত হবে না বন্য প্রাণীরাও। বনের সারি সারি গাছের গায়ে বেঁধে দেওয়া রোপওয়ে বা দড়ির সেতুর ওপর দিয়ে তৈরি হয়েছে চলাচলের রাস্তা। দর্শনার্থীদের জন্য এমন ব্যবস্থার নাম ইকো অ্যাডভেঞ্চার। প্রকৃতিপ্রেমীদের নীরবে ও নিরাপদে জীববৈচিত্র্য দেখার সুযোগ করে দিতেই বন বিভাগ এমন উদ্যোগ নেয়। শতবর্ষী এক মা গর্জনগাছ থেকে অন্য মা গর্জনগাছে রোপওয়ের মাধ্যমে পার হওয়ার রোমাঞ্চকর অনুভূতি পাওয়া যায়। ট্রি অ্যাডভেঞ্চারের মাধ্যমে সবুজ বন ও জীববৈচিত্র্য দেখার সুযোগ পান প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকেরা। তবে গত মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা গেছে, রোপওয়ে বা দড়ির সেতুটি জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। দর্শনার্থীরা মেধাকচ্ছপিয়া বন ঘুরে দেখলেও দড়ির সেতু দিয়ে হাঁটতে পারছেন না। দুই ঘণ্টা অবস্থান করেও সেখানে দায়িত্বশীল কাউকে পাওয়া যায়নি।

মেধাকচ্ছপিয়া বনবিট কর্মকর্তা বলেন, শত শত গর্জনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে আকাশছোঁয়া ঢাকিজাম, ভাদি, তেলসুর ও চাপালিশ গাছ। উদ্যানে রয়েছে মেছো বাঘ, হাতি, বানর, উল্টো লেজ বানর, বনবিড়াল, বনমোরগ, ইগল, সবুজ ঠোঁট ফিঙে, চিল, শ্যামা, গুইসাপসহ নানা প্রজাতির প্রাণী।

মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানে বেড়াতে এলে পাশের ডুলাহাজারায় অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কও ঘুরে যেতে পারেন পর্যটকেরা। ২০০১ সালের ১৯ জানুয়ারি ২ হাজার ২৫০ একর বনাঞ্চলে গড়ে তোলা হয় দেশের প্রথম এই সাফারি পার্ক। বর্তমানে পার্কের বিভিন্ন বেষ্টনীতে আছে সিংহ, বাঘ, জেব্রা, ওয়াইল্ড বিস্ট, জলহস্তী, ময়ূর, অজগর, কুমির, হাতি, ভালুক, হরিণ, শকুন, কচ্ছপ, রাজধনেশ, কাক ধনেশ, ইগল, সাদা বক, রঙ্গিলা বক, সারস, কাস্তেচরা, মথুরা, নিশিবক, কানিবক, বনগরুসহ ৫২ প্রজাতির ৩৪১ প্রাণী।

বন্য পশু–পাখির বিচরণ দেখতে গায়ের ওপর চলাচলের রাস্তা–ট্রি রাইড
প্রথম আলো

যেভাবে যাবেন

মেধাকচ্ছপিয়া উদ্যানে যেতে হলে চকরিয়ার মেধাকচ্ছপিয়া এলাকায় বাস থেকে নামতে হবে। কক্সবাজার শহর থেকে ৪৩ কিলোমিটার দূরে এবং চকরিয়া পৌর শহর থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে মেধাকচ্ছপিয়া বনের অবস্থান। কক্সবাজার শহর থেকে জনপ্রতি বাসভাড়া ৬০ টাকা আর চকরিয়া পৌর শহর থেকে ৩০ টাকায় এই বনে পৌঁছানো যায়। তবে বনের ভেতরে নেই কোনো থাকার ব্যবস্থা। তাই দিনে এসে দিনেই ফিরে যেতে হবে।