ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গাজীপুরের বড়বাড়ি মোড় এলাকায় পায়ে গুলিবিদ্ধ হন পোশাক কারখানার শ্রমিক মো. মোস্তাকিম (১৯)। আহত অবস্থায় তাঁকে ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
পায়ে ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে এক দিন পর তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে ক্ষতস্থান শুকানোর পর অস্ত্রোপচার করার কথা জানান চিকিৎসক। টাকার অভাবে উন্নত চিকিৎসা নিতে পারেননি। কিনতে পারছেন না প্রয়োজনীয় ওষুধ। গ্রামের বাড়ির বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তিনি।
গুলিবিদ্ধ মো. মোস্তাকিম নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার সাতুর গ্রামের বাচ্চু মিয়া ও পুষ্পা আক্তার দম্পতির দ্বিতীয় ছেলে। আক্ষেপ করে বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘একমাত্র উপার্জনশীল ছেলেডা আহত হয়ে বিছানায় শুইয়া আছে। আমি নিজেও পঙ্গু। ছেলেডার অপারেশন করতে অনেক টাকা খরচ লাগব, ক্যামনে কী করবাম, কিছুই মাথায় ধরে না। ঘোর অন্ধকার দেখতাছি।’
স্বজন ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০ জুলাই দুপুরে বাজার করতে মোস্তাকিম গাজীপুরের বড়বাড়ি মোড় এলাকার বাসা থেকে বের হন। কারফিউ ভেঙে আন্দোলনকারীরা সড়কে বিক্ষোভ করতে থাকেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। এ সময় একটি গুলি এসে মোস্তাকিমের ডান পায়ের হাঁটুর নিচে লেগে বের হয়ে যায়। মুহূর্তেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আশপাশের লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে পাশের একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে ঢাকার পঙ্গু (জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান) হাসপাতালে পাঠান। সেখানে পায়ে ব্যান্ডেজ করে কোনো রকম চিকিৎসা দিয়ে পরদিন তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ সময় কর্তব্যরত চিকিৎসক জানিয়েছেন, গুলিতে মোস্তাকিমের পায়ের রগ ছিঁড়ে গেছে। ক্ষতস্থান শুকানোর পর অস্ত্রোপচার করতে হবে। পরে স্বজনেরা তাঁকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসেন। সেই থেকে ব্যান্ডেজ প্যাঁচানো পা নিয়ে বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন মোস্তাকিম। টাকার অভাবে তাঁর চিকিৎসা হচ্ছে না।
মোস্তাকিমের বাবা বাচ্চু মিয়া প্রায় ১১ বছর আগে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় এক পা ভেঙে যায়। তখন থেকেই তিনি অচল হয়ে আছেন। মোস্তাকিমদের অভাবের পরিবার। থাকার জায়গা ছাড়া সহায়-সম্বল বলতে কিছু নেই। ভাঙা পা নিয়ে বাড়ির কাছে ছোট একটি টংদোকান চালান বাচ্চু মিয়া। তাঁর চার ছেলের মধ্যে বড় ছেলে মিজানুর রহমান বছর তিনেক আগে বিয়ের করে আলাদা হয়ে গেছেন। ছোট দুই ছেলে পড়াশোনা করে। পরিবারের অভাব ঘোচাতে স্থানীয় মাদ্রাসা থেকে হাফেজি পাস করা মোস্তাকিম পোশাক কারখানায় কাজ নেন। তাঁর আয়েই চলছিল পাঁচ সদস্যের পরিবারটি। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে বিছানায় শুয়ে মোস্তাকিমকে যন্ত্রণায় দিন যাপন করতে হচ্ছে। তাঁর উপার্জন বন্ধ হওয়ায় পরিবারের সদস্যরাও মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
আলাপকালে গুলিবিদ্ধ মো. মোস্তাকিম বলেন, পরিবারের অভাবের কারণে হাফেজি পাস করার পর গাজীপুরে পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়েছিলেন। আন্দোলনের কারণে কারখানা বন্ধ ছিল কয়েক দিন ধরেই। তার পর আবার কারফিউ চলছিল। খাবার জিনিসপত্র কেনার জন্য ২০ জুলাই বেলা ৩টার দিকে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত দেখে বাসা থেকে বের হন। হঠাৎ দেখেন, সড়কে আন্দোলনকারীরা। মুহূর্তে তাদের দিকে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে পুলিশ। তাঁর পাশে দুজন গুলিতে মারা যান। আরও অনেকের হাতে-পায়ে গুলি লাগে। পরিস্থিতি খারাপ দেখে দৌড় দেন। তখনই একটি গুলি এসে তাঁর পায়ের হাঁটু বরাবর লাগে। গুলিটা পায়ের একপাশে লেগে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। তখনই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে চেতনা হারান। এরপর কী হয়েছে, তা তিনি জানেন না।
মোস্তাকিমের মা পুষ্প আক্তার বলেন, তাঁর স্বামী দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে গেছেন। বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা থাকেন। মোস্তাকিমই সংসার চালাতেন। হাতে কোনো টাকাপয়সা নেই। এ অবস্থায় ছেলের চিকিৎসা কীভাবে করাবেন? দেশের সরকার বা বিত্তবানরা যদি সাহায্য করতেন, ছেলেটাকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা যেত।
প্রতিবেশী জুয়েল মিয়া বলেন, মোস্তাকিম খুবই ভালো ছেলে। তিনি মাদ্রাসা থেকে হাফেজি পাস করে পোশাক কারখানায় চাকরি নেন। আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে এখন তিনি বিছানায় শুয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। টাকার জন্য চিকিৎসা করাতে পারছেন না। সবার একটু সহযোগিতা পেলে তিনি সুস্থ হয়ে আবার কাজে ফিরতে পারতেন।