চাঁপাইনবাবগঞ্জ
সিল্ক কাপড়ের ব্যবসায় ধস, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাঁত
চাঁপাইনবাবগঞ্জের হরিনগরের তাঁতিপাড়ায় আগে ১৫০০ থেকে ২০০০ তাঁত চালু ছিল। এখন মাত্র ৫০০টি তাঁত চালু আছে।
হস্তচালিত তাঁতের খটখট শব্দে একসময় সরব ছিল এলাকাটি। আস্তে আস্তে শব্দটা ক্ষিণ হতে শুরু করেছে। হয়তো একদিন একেবারেই এই শব্দ বন্ধ হয়ে যাবে। এটা অন্য মানুষের কাছে কাঠখোট্টার এক শব্দ, কিন্তু এ শব্দ এই পাড়ার বাসিন্দাদের জীবনেরই ছন্দ। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে পাড়ার বাসিন্দাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, ভালোবাসা, উত্থান-পতন। এখানকার মানুষকে একদিন জীবনের নতুন ছন্দ খুঁজতে হবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী তাঁতিপাড়া হরিনগরের দুরবস্থা প্রথম আলোর কাছে এভাবেই তুলে ধরলেন এ পাড়ার ‘শুভ সিল্ক’-এর মালিক শুভময় দাস। ৪৩ বছর বয়সী শুভময় দাস একটি বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করলেও পূর্বপুরুষের পেশাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। কিন্তু এই রেশম শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁতিপাড়ার অন্য ব্যবসায়ীদের মতো তিনিও হতাশা প্রকাশ করলেন।
হরিনগর তাঁতিপাড়ার কয়েকজন তাঁতি ও কারখানার মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হরিনগর সিল্ক তাঁতিপাড়ায় ক্রমে কমছে তাঁতের সংখ্যা। কমছে উৎপাদন ও ব্যবসার পরিধি। বাড়ছে সুতার দাম। কিন্তু সে তুলনায় বাড়ছে না কাপড়ের দাম। এখানকার উৎপাদিত রেশম সিল্কের বিভিন্ন প্রকার কাপড়ের ব্যবসা প্রায় সম্পূর্ণরূপেই আড়ং অর্থাৎ ব্র্যাকের ওপর নির্ভরশীল। ব্র্যাকের বাইরে সিল্কের কাপড় বিক্রির বাজার নেই বললেই চলে। তাদের বেঁধে দেওয়া দরেই বিক্রি করতে হয় কাপড়। উৎপাদনও করতে হয় তাদের পছন্দমতো। ব্র্যাকও এখন আর আগের মতো কাপড় কিনছে না। ঈদ উপলক্ষে ব্র্যাক যে পরিমাণ কাপড় কেনে, এবার তার থেকে অন্তত ৩০ শতাংশ কম কিনেছে। এ কারণে কাজও কমে গেছে।
তাঁতি পরিবারের সন্তান অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক ভঞ্জন কুমার দাস (৬৫), চণ্ডীচরণ সিল্কের স্বত্বাধিকারী পলাশ কুমার দাস, অরিত্র সিল্কের স্বত্বাধিকারী বিমল দাস ও আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১০-১৫ বছর আগে এ গ্রামে ১৫০০ থেকে ২০০০ তাঁত চালু ছিল। ব্যবসা কমে যাওয়ায় কমতে কমতে তা এখন ৫০০–তে এসে দাঁড়িয়েছে। এটি ক্রমে কমতেই থাকবে বলে মনে করেন তাঁরা। তাঁদের আশঙ্কা, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে একসময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রেশম সিল্কশিল্প।
জেলার আরেকটি তাঁতিপাড়া সদর উপজেলার লাহারপুর। সম্প্রতি লাহারপুরে গিয়ে দেখা যায়, হাতে গোনা কয়েকটি তাঁত চালু আছে। বাকিগুলো বন্ধ। এ সময় কথা হয় ওই পাড়ার তাঁতি চন্দন কুমার দাস, ঝাটু লাল দাস, দীপক কুমার দাসের সঙ্গে। তাঁরা জানান, সাত-আট বছরের ব্যবধানে তাঁতের সংখ্যা এক–তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। এখন এ পাড়ায় চালু আছে প্রায় ১০০ তাঁত।
ঝাটু লাল দাস (৪৭) বলেন, ‘আমার ৪০টি তাঁত চালু ছিল। আড়ংয়ের বাইরেও কাপড় বিক্রি করতাম। এখন আড়ং ছাড়া কেনার কেউ নেই। পাঁচ বছরে কমতে কমতে ১০টি তাঁতে এসে ঠেকেছে। নতুন করে কেউ আর তাঁতের কাজ শিখছে না। এ পাড়ার তরুণ ও যুবকেরা বিদেশে চলে যাচ্ছে। আমার প্রজন্মের পর আর কাউকে নতুন করে কাজ শিখতে দেখছি না। এ ছাড়া অন্য প্রতিবন্ধকতা তো আছেই। একসময় কারিগরের অভাবে এ শিল্প বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কেননা, কারিগরেরা সারা দিনে ৩৫০-৫০০ টাকার বেশি আয় করতে পারে না। এ টাকায় তাদের সংসার চলে না।’
হরিনগর ও লাহারপুরের তাঁতিরা জানান, ১৫-২০ দিন আগে আমদানি করা চায়না সিল্ক সুতার দাম প্রতি কেজিতে দুই হাজার টাকা বেড়েছে। এ ছাড়া আগে সিল্কের যেসব সুতার দাম প্রতি কেজি ৭ হাজার থেকে ৭ হাজার ৫০০ টাকা ছিল, সেসব সুতা এখন ৯ হাজার থেকে ৯ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু সুতার দাম বাড়লেও কাপড়ের দাম বাড়েনি।