‘ও মারে, তুই আরেকবার আমার বুকে আয়। তোমরা আমার মেয়েকে আমার বুকে ফিরিয়ে এনে দাও না। আমার মেয়েকে ওরা দুপুরে ভাতও খেতে দেয়নি। আমার মেয়ে শখ করে ইলিশ রান্না করেছিল। সেই ইলিশ মাছও আমার মেয়ে খেতে পারেনি। আমার মেয়েকে ধর্ষণ করে গলা কেটে হত্যা করেছে ওরা।’
আর্তনাদ করতে করতে কথাগুলো বলছিলেন নোয়াখালী শহরে নিজ বাড়িতে হত্যার শিকার স্কুলছাত্রীর (১৪) মা। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নিজ বাড়ি থেকে ওই স্কুলছাত্রীর গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত স্কুলছাত্রীর মায়ের অভিযোগ, তাঁর মেয়েকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে মো. সাঈদ (২০) নামের এক তরুণকে আটক করেছে পুলিশ।
আজ শুক্রবার সকালে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মেয়ের শোকে শয্যাশায়ী মায়ের কান্না কিছুতেই থামছে না। স্বজন–প্রতিবেশীরা তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
বিলাপ করে ছাত্রীর মা বলেছিলেন, ‘আমার কী অপরাধ! তাঁরা কেন আমার মেয়েকে এভাবে নৃশংসভাবে মেরে ফেলল। আমার মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার ব্যাপারে এই এলাকার সবাইকে বলেছি, কেউ আমার কথা শোনেননি। কেউ উত্ত্যক্তকারীদের বিচার করেননি। তাঁরা যদি সময়মতো বিচার করতেন, তাহলে আজ আমার মেয়েকে এভাবে অকালে জীবন দিতে হতো না। আমি আমার মেয়েকে ছাড়া কীভাবে বাঁচব! কী নিয়ে থাকব!’
নিহত স্কুলছাত্রীর পরিবার সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকালে স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে বাসায় রেখে নিজ কর্মস্থলে যান ওই নারী। সন্ধ্যায় ওই নারী বাসায় ফিরে দেখেন দরজায় তালা ঝুলছে। পরে নিজের কাছে থাকা চাবি দিয়ে দরজা খুলতেই দেখেন, কক্ষের ভেতর জিনিসপত্র এলোমেলো অবস্থায় পড়ে আছে। এ সময় ভেতরের একটি কক্ষের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ দেখতে পান। পরে বাইরে গিয়ে জানালা দিয়ে দেখেন, ওই কক্ষের ভেতর তাঁর মেয়ের গলাকাটা লাশ পড়ে আছে।
এ সময় ওই নারীর চিৎকারে প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন। পরে দরজা ভেঙে ওই ছাত্রীর রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। খবর পেয়ে রাত সাড়ে আটটার দিকে সুধারাম থানা–পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। কিছুক্ষণ পর জেলা পুলিশ সুপার মো. শহীদুল ইসলামসহ পিবিআই, সিআইডি ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে।
আজ সকালে ওই ছাত্রীর মা বলেন, ২০১২ সালে তাঁর স্বামী মারা গেছেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে তিনি দুই মেয়েকে নিয়ে অনেক কষ্টে সংসার চালাতেন। এর মধ্যে বড় মেয়ে শরীরিক প্রতিবন্ধী। তিনি ঢাকা থাকেন। ছোট মেয়েকে নিয়ে তিনি নোয়াখালী শহরে থাকতেন। সকালে তিনি কর্মস্থলে যান এবং সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতেন। পড়াশোনার ফাঁকে ওই ছাত্রী ঘরের সব কাজ করত।
নিহত ছাত্রীর মামা বলেন, তাঁর ভাগনিকে এভাবে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, সেটা ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। তিনি এই নৃশংস হত্যকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান।
ওই ছাত্রীর মৃত্যুর খবর শুনে তার সহপাঠী ও অভিভাবকেরাও ছাত্রীর বাড়িতে ভিড় করেছেন। দুজন সহপাঠী প্রথম আলোকে বলেন, তাদের সহপাঠী ওই ছাত্রী অত্যন্ত শান্ত ও মিশুক প্রকৃতির ছিল। পড়াশোনাতেও সে ভালো ছিল। তাদের অনেক ভালো সখ্য ছিল। এসব কথা বলতেই কেঁদে ফেলে দুই সহপাঠী।
হত্যকাণ্ডের বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপার মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিকভাবে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে মো. সাঈদ (২০) নামের এক তরুণকে আটক করা হয়েছে। এ ছাড়া রাতে আরও দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নেওয়া হয়েছে।
সুধারাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, স্কুলছাত্রী হত্যার ঘটনাটি তাঁরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছেন। এ ঘটনায় একজনকে আটক করা হয়েছে এবং দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়েছে। এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে। শিগগিরই তদন্তের অগ্রগতি জানা যাবে বলে আশা করছেন তিনি।