উচ্চমাত্রায় লবণ, আয়রন ও আর্সেনিকের কারণে প্রথম স্তরের ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করতে পারেন না খুলনা নগরবাসী। দ্বিতীয় স্তরেও লবণের পরিমাণ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি। ফলে পানি তুলতে নলকূপের বদলে সাবমারসিবল পাম্পে ঝুঁকছেন বাসিন্দারা। ভূগর্ভস্থ পানির ওপর অতি নির্ভরতাকে ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে তা মহাবিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
খুলনা ওয়াসার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১০ বছর আগেও নগরে ১২০–১২৫ ফুট গভীরতায় নলকূপ দিয়ে পানি তোলা যেত। এখন সেটি ১৩০ থেকে ১৩৫ ফুটে ঠেকেছে। প্রতিবছর গড়ে ছয় ইঞ্চি করে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। এতে নগরের অধিকাংশ নলকূপই এখন অকেজো। এ অবস্থায় বাড়ি বাড়ি বসানো হচ্ছে সাবমারসিবল পাম্প।
পানির স্তর নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, খুলনায় মাটির নিচে পানির তিন ধরনের স্তর (অ্যাকুইফার) আছে। ভূ-উপরিভাগ থেকে ১৬৫ ফুট গভীরতাকে উপরিভাগের অগভীর জলাধার (আপার শ্যালো অ্যাকুইফার), ১৬৫ থেকে ৬৫০ ফুট গভীরতাকে অগভীর জলাধার (শ্যালো অ্যাকুইফার) এবং ৬৫০ থেকে ৯৮০ ফুট গভীরতাকে গভীর জলাধার বলা হয়। উচ্চমাত্রায় লবণ, আয়রন ও আর্সেনিকের কারণে খুলনায় ইতিমধ্যে প্রথম স্তরের ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা যায় না। দ্বিতীয় স্তরেও লবণের পরিমাণ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি। নলকূপ দিয়ে তৃতীয় স্তরের পানি না পাওয়া যাওয়ায় সাবমারসিবল পাম্প ব্যবহার করছেন বাসিন্দারা। যদিও কয়েক বছর আগে সুপেয় না হলেও বিভিন্ন কাজে প্রথম দুই স্তরের পানি ব্যবহার করতেন তাঁরা। কিন্তু বর্তমানে ওই দুই স্তরের পানি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। শুষ্ক মৌসুমে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে।
নগরে সাবমারসিবল পাম্পের ব্যবহার বাড়ছে। সবাই যেভাবে ভূগর্ভের পানি তুলছে, সেভাবে পুনর্ভরণ হচ্ছে না। এখনই লাগাম টেনে না ধরলে ভবিষ্যতে মারাত্মক পানি সংকটে পড়তে হবে।
গবেষকেরা বলছেন, উপকূলীয় এলাকায় মাটির বিশেষ ধরনের কারণে গভীর জলাধারের উপরিভাগে পুরু কাদামাটির স্তর আছে। বৃষ্টির পানি গভীর জলাধারে প্রবেশ করে কম। ফলে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে যে পরিমাণ পানি উঠছে, সেভাবে পুনর্ভরণ হচ্ছে না। গভীর জলাধার থেকে যে পানি তোলা হচ্ছে, তা ৬০০ থেকে ২৫ হাজার বছর আগের পানি।
ওয়াসাও খুলনায় ব্যবহারযোগ্য পানি সরবরাহ করাকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে। সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, অনাবৃষ্টি, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লবণাক্ততা বেড়েছে। পাশাপাশি পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সুপেয় পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা ওয়াসার জন্য চ্যালেঞ্জ।
ব্যাপকভাবে ভূগর্ভস্থ পানি তুলছে ওয়াসা
১৫ বছর ধরে নগরে পানি সরবরাহ করে খুলনা ওয়াসা। খুলনা নগরের ৭৩ হাজার বাসাবাড়িতে (হোল্ডিং) ১৫ লাখ মানুষের বসবাস। এর মধ্যে ৪১ হাজার বাসায় ১১ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করে সংস্থাটি। ভূগর্ভস্থ উৎস ও মধুমতি নদীর পানি শোধন করে এই পানি সরবরাহ করা হয়। বাকি ৩২ হাজার বাসার পুরোটাই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ষাকালে দিনে আট ঘণ্টা করে ৩০টি উৎপাদক নলকূপ চালায় ওয়াসা। বাকি ৯ মাস ১৬ ঘণ্টা করে চালানো হয়। সেই হিসাবে বর্ষাকালে দিনে গড়ে সাড়ে ৩ কোটি লিটার এবং অন্য সময় প্রতিদিন ৬ থেকে সাড়ে ৬ কোটি লিটার ভূগর্ভস্থ পানি তোলা হয়। জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে প্রতিদিন মধুমতি থেকে পানি শোধন করে ৪ কোটি ৬০ লাখ লিটার পানি বিতরণ করেছে ওয়াসা। বাকি ৬ কোটি ৪০ লাখ ভূগর্ভের পানি সরবরাহ করেছে ওয়াসা। অর্থাৎ গ্রাহকের চাহিদার প্রায় ৫৮ শতাংশ পানি ভূগর্ভস্থ থেকে তুলছে ওয়াসা।
নগরে জনসংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু পানির বিষয়টি চিন্তা না করেই সব উন্নয়ন হচ্ছে বলে মনে করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের সাবেক অধ্যাপক ও পানিবিশেষজ্ঞ দিলীপ কুমার দত্ত। ১০-১৫ বছর পর খুলনায় পানির জন্য হাহাকার হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভূগর্ভস্থ পানি তোলা নিরাপদ নয়। সেটা অমূল্য সম্পদের মতো। ২০ লিটার পানির চাহিদা থাকলে ওই স্তর থেকে সর্বোচ্চ ২ লিটার তোলা যেতে পারে। সেখানে বর্তমানে ৫০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত তোলা হচ্ছে। এটা খুবই বিপজ্জনক।
সূত্র জানায়, প্রথম দিকে পুরোটাই ভূগর্ভস্থ পানি তুলত ওয়াসা। ভূগর্ভের ওপর চাপ কমাতে আড়াই হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে সংস্থাটি। ৫৮ কিলোমিটার দূরের মধুমতি নদী থেকে পানি এনে শোধন করছে ওয়াসা। কিন্তু সেই পানি বছরের বড় একটা সময় লবণাক্ত থাকায় প্রকল্প নিয়ে সমালোচনা রয়েছে।
প্রতিটি বাড়িতে বসছে পাম্প
ওয়াসার পানি না পাওয়া জনগোষ্ঠীর প্রায় সবাই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। অনেকে জারের কেনা পানি ব্যবহার করেন। সেই পানিও ভূগর্ভ থেকে তোলা হচ্ছে। শহরে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বাড়ি হচ্ছে। প্রায় প্রতিটি বাড়ির মালিক সাবমারসিবল পাম্প বসাচ্ছেন।
জুলাই মাসে দৈবচয়ন ভিত্তিতে নগরের নিরালা, পূর্ব বানিয়াখামার ও মুজগুন্নী এলাকায় নির্মাণাধীন ১৫টি বাড়ির মালিকের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তাঁরা প্রত্যেকেই সাবমারসিবল পাম্প বসিয়ে বাড়ির কাজ শুরু করেছেন। ওই এলাকার ছয়টি পুরোনো বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রীষ্মকালে নলকূপে পানি না ওঠায় ছয়টির মধ্যে চারটি বাড়িতে সাবমারসিবল পাম্প বসানো হয়েছে। এ ছাড়া এলাকাবাসীর পানির সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন জায়গায় সাবমারসিবল পাম্প বসিয়েছেন বিভিন্ন ওয়ার্ড কাউন্সিলররা।
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান মো. মোস্তফা সারোয়ার বলেন, নগরে বাড়ি করতে প্রাথমিকভাবে পাম্প বসানোর অনুমতি নেওয়া হচ্ছে। পরে দেখা যাচ্ছে, পাম্পগুলো স্থায়ীভাবে ব্যবহার করছেন মালিকেরা। এতে সাবমারসিবল পাম্পের ব্যবহার বাড়ছে। সবাই যেভাবে ভূগর্ভের পানি তুলছে, সেভাবে পুনর্ভরণ হচ্ছে না। এখনই লাগাম টেনে না ধরলে ভবিষ্যতে মারাত্মক পানি সংকটে পড়তে হবে।
খুলনা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, নগরে আগে সবাই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। ওয়াসার মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে সেটি অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, নগরে পানির চাহিদা ১১ কোটি লিটারের পুরোটাই ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থেকে সরবরাহ করার সক্ষমতা আছে। সে জন্য প্রতি লিটার পানির খরচ ১৭ টাকার বেশি পড়ে যায়। সেই তুলনায় ভূগর্ভের পানির খরচ কম। খরচ সমন্বয় করতে ভূগর্ভের পানি তোলা হচ্ছে।
মধুমতি বা আশপাশের নদী থেকে পানি আনা ভীষণ অবৈজ্ঞানিক বলে মনে করেন গবেষক দিলীপ কুমার দত্ত। তিনি বলেন, শুষ্ক মৌসুমে ওই নদী থেকে মিঠা পানি তুলে ফেললে সাগর থেকে লবণাক্ত পানি আসবে। মধুমতি অঞ্চলে ইতিমধ্যে সেটাই হয়েছে। তিনি আরও বলেন, খুলনা নগরে ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ ময়ূর নদের কোনো প্রবাহ নেই। নদটি খনন করে মিষ্টি পানির আধার বানানো যেতে পারে। শহরের পানি শোধন করে নদীতে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। দূষণ কমাতে কঠোর নজরদারি করতে হবে।