মহেশখালীর সোনাদিয়ায় প্যারাবন কেটে আরও চিংড়িঘের তৈরি
এবার প্রায় ১ হাজার ১০ একর প্যারাবন ধ্বংস করে ১০টির বেশি চিংড়িঘের নির্মাণ করছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।
কক্সবাজারের মহেশখালীর সংকটাপন্ন সোনাদিয়া দ্বীপে প্যারাবন নিধন থেমে নেই। প্যারাবনের গাছ কেটে চলছে চিংড়িঘেরের নির্মাণকাজ। এবার প্রায় ১ হাজার ১০ একর প্যারাবন ধ্বংস করে ১০টির বেশি চিংড়িঘের নির্মাণ করছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।
মাসের পর মাস ধরে প্যারাবন ধ্বংস করে চিংড়িঘের নির্মাণের কারণে ঝুঁকির মুখে রয়েছে বঙ্গোপসাগরের মোহনার ছোট দ্বীপ সোনাদিয়া। বন ধ্বংসকারী সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেও স্থানীয় প্রশাসন, বন বিভাগ ও বেজা কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতারা।
প্যারাবনের দখল নিয়ে দুই পক্ষের গোলাগুলিতে গত ২ মার্চ দুজন মারা গেছেন। এই ঘটনায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আগের ঘটনায় ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্যারাবন নিধন থামছে না।ফজলুল কাদের চৌধুরী, সভাপতি, কক্সবাজার, ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)
এর আগে গত চার মাসে দ্বীপের প্রায় দুই হাজার একর প্যারাবন নিধন করে ৩৭টি চিংড়িঘের নির্মাণ করেছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীসহ শতাধিক প্রভাবশালী। এ নিয়ে গত ১৩ জুন প্রথম আলোতে ‘সংকটাপন্ন সোনাদিয়াতে গাছ কেটে আওয়ামী লীগ নেতাদের মাছ চাষ’ শীর্ষক সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতারা জানান, প্রতিবেদন প্রকাশের পর কিছুদিন চিংড়িঘের নির্মাণের কাজ বন্ধ রাখা হলেও ২০ জুন তা পুনরায় শুরু হয়।
কক্সবাজার শহর থেকে ১১ কিলোমিটার উত্তরে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় ছোট্ট দ্বীপ সোনাদিয়া। লাল কাঁকড়া, কাছিম ও বিরল পাখির কারণে এই দ্বীপ সুপরিচিত। সোনাদিয়া দ্বীপটিকে ২০০৬ সালে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। মানে হলো, সেখানকার মাটি, পানি ও প্রাকৃতিক পরিবেশের কোনো পরিবর্তন করা যাবে না।
প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) সোনাদিয়া দ্বীপে গাছ কেটে (প্যারাবন) চিংড়িঘের নির্মাণ কার্যক্রম বন্ধে দুই সচিবসহ সাতজন সরকারি কর্মকর্তাকে গত ২৭ জুন আইনি নোটিশ দিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)।
বেলার আইনজীবী জাকিয়া সুলতানা বলেন, উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরও সোনাদিয়া দ্বীপের প্যারাবনের গাছ কেটে চিংড়িঘের তৈরি আদালত অবমাননার শামিল। বন রক্ষায় আবার আদালতে যাবেন তাঁরা।
ইকো-ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলার জন্য সরকার নামমাত্র সেলামিতে (১ হাজার ১ টাকা) সোনাদিয়ার ৯ হাজার ৪৬৬ দশমিক ৯৩ একর বনভূমি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) বরাদ্দ দেয়। এর মধ্যে প্যারাবন পড়েছে অন্তত ৮ হাজার একর। ২০১৭ সালের মে মাসে বেজা উপকূলীয় বন বিভাগের কাছ থেকে তা অধিগ্রহণ করে। কিন্তু এখনো তা নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনি বেজা। এই বিশাল এলাকা পাহারার দায়িত্বে আছেন ৫ জন নিরাপত্তাকর্মী ও আনসারের ১০ জন সদস্য।
চিংড়িঘের নির্মাণ চলছে
গত ২৭ জুন দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, ৮-৯টি খননযন্ত্র (এক্সকাভেটর) দিয়ে চিংড়িঘেরের বেড়িবাঁধের নির্মাণকাজ চলছে। ইতিমধ্যে শ্রমিকেরা গাছপালা কেটে সাফ করেছেন। কিছু অংশে পেট্রল ঢেলে আগুনে গাছপালা পুড়িয়ে ফেলার দৃশ্য চোখে পড়ে।
সোনাদিয়ার পশ্চিমে অন্তত ২০০ একরের প্যারাবন কেটে চিংড়িঘের নির্মাণ করছেন কয়েকজন শ্রমিক। একজন শ্রমিক জানান, ওই চিংড়িঘের নির্মাণ করছেন সোনাদিয়া ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল কালামের নেতৃত্বে ১০-১২ জন প্রভাবশালী। গত ২০ জুন প্যারাবনের গাছ কাটা শুরু হয়। এখন পর্যন্ত ৭০-৮০ হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়।
তবে দ্বীপে নিজের কোনো ঘের নেই বলে দাবি করে আবুল কালাম বলেন, মহেশখালীর রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা সোনাদিয়ায় এসে প্যারাবন দখল করে চিংড়িঘের করছেন।
একইভাবে প্যারাবন ধ্বংস করে চিংড়িঘের নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম, কুতুবজোম ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ তারেক, আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন, স্থানীয় প্রভাবশালী মোহাম্মদ কাসেমের বিরুদ্ধে। তাঁরা সবাই প্যারাবন কেটে চিংড়িঘের নির্মাণে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেন।
তবে প্যারাবন ধ্বংসের সঙ্গে স্থানীয় নেতারা জড়িত বলে স্বীকার করেন মহেশখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কালারমারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তারেক বিন ওসমান শরীফ।
প্যারাবন ধ্বংস, প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
মহেশখালীর ইউএনও মীকি মারমা বলেন, প্যারাবন নিধন করে চিংড়িঘের নির্মাণের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বেজা কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা মামলা করেনি। বেজা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে অবৈধ চিংড়িঘের উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করা হবে।
তবে দখলদারদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে বলে দাবি করেন বেজার সোনাদিয়া ইকো-ট্যুরিজম পার্কের দায়িত্বে থাকা সহকারী ব্যবস্থাপক হাবিবুর রহমান।
প্যারাবন রক্ষায় আন্দোলনরত পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতা ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, দখলদার ও বন ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রশাসন, বেজা ও বন বিভাগ কেউই কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
পরিবেশবাদী সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) কক্সবাজার জেলা সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, প্যারাবনের দখল নিয়ে দুই পক্ষের গোলাগুলিতে গত ২ মার্চ দুজন মারা গেছেন। এই ঘটনায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আগের ঘটনায় ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্যারাবননিধন থামছে না।