বৈশেল জেলেদের সঙ্গে সুন্দরবনে এক বেলা, ‘দাওন’ দিয়ে মাছ ধরা
অর্ধেক ভাটা হয়ে গেছে। সুন্দরবনের খাল-নদী থেকে পানি নেমে যাচ্ছে কলকল শব্দে। দুই পাশে ঘন বনে সুন্দরী, গরান, গেওয়া, বাইন, গোলপাতাসহ নানা জাতের গাছ। ঝপঝোপিয়া নদী দিয়ে সুন্দরবনের বৈশেল জেলেদের দুটি ডিঙিনৌকা উজানে যাচ্ছে। অর্থাৎ স্রোতের বিপরীতে চলছে নৌকা। ডিঙিনৌকায় করে সুন্দরবনে ঢুকে নদী–খালে বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করেন তাঁরা। এই জেলেরা স্থানীয়ভাবে ‘বৈশেল’ নামে পরিচিত।
গত মঙ্গলবার বৈশেল জেলেদের সঙ্গী হয়ে তাঁদের মাছ শিকারের দৃশ্য দেখার সুযোগ হয়। ছোট দুটি ডিঙিনৌকায় আছেন কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী এলাকার বৈশেল জেলে পরিমল কুমার, মনোরঞ্জন মণ্ডল, গোবিন্দ মণ্ডল ও বিপ্লব কুমার। তাঁরা বংশপরম্পরায় সুন্দরবনের নদী–খালে মাছ শিকারের সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের সঙ্গে গল্পে গল্পে এগোতে থাকে নৌকা। ঝপঝোপিয়া নদী দিয়ে এঁকেবেঁকে নৌকা চলে যায় গহিন বনের মুচির খালে।
প্রবীণ জেলে গোবিন্দ মণ্ডল বললেন, ‘খালের মুখেই বড়শি ফেলব। কিন্তু বড়শির আধার কোথায়? মাছ ধরতে হলে আধার হিসেবে চিংড়ি লাগবে।’ তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই নৌকার পাটাতনের নিচ থেকে জাল বের করে লাফিয়ে খালের মধ্যে নেমে পড়লেন মনোরঞ্জন। বললেন, ‘চিন্তার কারণ নেই, চিংড়ি ধরতে জাল এনেছি।’
কয়েকবার জাল ফেলতেই বড়শির আধার হিসেবে প্রয়োজনীয় চিংড়ি জোগাড় হয়ে গেল। ঝটপট কয়েকটি বড়শি নিয়ে সুতায় বেঁধে বানানো হলো হাতবড়শি। সুতার মাথায় ভর হিসেবে বাঁধা হলো কয়েকটি লোহার তালা আর নাট-বল্টু। বড়শিতে আধার গেঁথে ছুড়ে ফেলা হলো মাঝখালে।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই মাছে দিল টান। বিপ্লব কুমার সুতা টেনে তুললেন বড় একটা গাগড়া ট্যাংরা। বড়শি থেকে মাছ ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন, সুন্দরবনের কম দামি মাছ এটি। এ জঙ্গলের নদী–খালে সবচেয়ে বেশি এই মাছ দেখা যায়। ঠিকঠাক রান্না করতে পারলে ভালোই লাগে।
পরিমল হাঁক ছেড়ে বললেন, ‘চলেন সামনে আগাই। নলবুনিয়া খালের মুখে দাওন দেব। ওইখানে মাছ বেশি।’ দাওন আবার কী? প্রশ্ন শুনে হাসতে হাসতে জেলে গোবিন্দ মণ্ডল বলেন, ‘দাওন মানেই বড়শি, এটাও জানেন না!’
মুচির খাল থেকে বেরিয়ে ডিঙি দুটি নলবুনিয়া খালের মুখে পৌঁছায়। এরপর নৌকায় বসে নতুন করে দাওন বড়শি তৈরি করে নিলেন জেলেরা। লম্বা সুতায় অনেকগুলো বড়শি গেঁথে তৈরি করা হয় দাওন। দাওনের একেকটি বড়শিতে একটি করে চিংড়ি গেঁথে পানিতে ফেলা হলো।
বিপ্লব কুমার বললেন, দাওন দুভাবে পাতা যায়। বেশি ডুবিয়ে দিলে দাওনে ধরা পড়ে মেধ, মোচন, ট্যাংরা ও কাইন মাছ। আর ভাসিয়ে রাখলে দাওনে আটকা পড়ে পাতাড়ি-জাবাজাতীয় মাছ। পরিমল বললেন, ‘এখানে দাতিনা মাছও হয়। কপাল ভালো থাকলে তাইড়েলও পড়বে। তবে ভোলা মাছ আর গাগড়া ট্যাংরা প্রচুর আছে।’
ডোবা দাওনের বড়শিগুলো ডুবে থাকে পানির একদম নিচে। লোহার নোঙর দিয়ে সারিবদ্ধভাবে ফেলা হয়। এই বড়শিতে আধার হিসেবে দেওয়া হয় জঙ্গলের একজাতের ছোট কাঁকড়া। সেটি নাকি কাইন মাছের খুব প্রিয় খাবার। আর ভাসা দাওন পাততে হয় জঙ্গলের পাশ দিয়ে। গাছের ভেতর ও শিকড়ের ভেতর দিয়ে পেতে রাখা হয় লম্বা সুতা। তার সঙ্গে বাঁধা একেকটি বড়শিতে গাঁথা হয় আধার। এক দাওনে থাকে শতাধিক বড়শি।
নৌকার পাটাতনের ওপর বসে হাতবড়শিতে আধার গেঁথে গোবিন্দ মণ্ডল বললেন, ‘সবাই একটু মাথাটা নিচু করেন তো।’ কিছু না বুঝেই মাথা নিচু করে বসলাম। দেখলাম, নৌকায় দাঁড়িয়ে বড়শির সুতা হাতে নিয়ে মাথার ওপর দিয়ে কয়েকবার ঘুরিয়ে ছুড়ে মারলেন। বড়শিসহ সুতার এক প্রান্ত উড়ে গিয়ে পড়ল অন্তত ১০০ হাত দূরে খালের মাঝবরাবর। এভাবে আরও কয়েকটি হাতবড়শি ফেলা হলো খালে।
বড়শি ফেলে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। বড়শিতে মাছ উঠছে একের পর এক। অনেকগুলো দাতিনা মাছ পাওয়া গেল। ট্যাংরা আর কাইন মাছও আটকা পড়েছে বেশ কয়েকটি; তবে সেগুলো বড় নয়। বড়শি থেকে মাছ খুলে নৌকার ভেতর রাখা হচ্ছে। নৌকায় মনে হলো কম্পন লেগেছে। ছটফট করছে মাছগুলো।
গোবিন্দ মণ্ডল বললেন, একসময় এই অঞ্চলে কাইন মাছের অভাব ছিল না। এক ভাটায় দাওন দিলে হাপর (বাঁশের তৈরি একধরনের খাঁচা। পানিতে ডুবিয়ে মাছ জিইয়ে রাখা হয় এ খাঁচায়) ভরে যেত। কিন্তু আগের মতো এখন আর মাছ পাওয়া যায় না। বিষ দিয়ে সব মাছ শেষ করে দিচ্ছে মানুষ। সুন্দরবনে সারা বছর চলে ওই অপকর্ম।
ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে গেছে। নৌকার মাথায় বসানো হলো বিশেষ কায়দায় বানানো টিনের চুলা। নৌকার গলুইয়ে চলছে মাছ কাটিকুটির কাজ। এরপর লবণ ও মসলা মাখিয়ে মাছ উঠল চুলায়। শর্ষের তেল দিয়ে ভাজা সেই মাছের স্বাদ ছিল অসাধারণ।
দুপুরের খাওয়া সারতে সারতে বিকেল হলো। এবার পেতে রাখা বড়শি তুলতে হবে। শুরু হয় একটি–দুটি করে বড়শি ওঠানো। এভাবে অনেকগুলো বড়শি ওঠালেও মাছ নেই। হঠাৎ বড়শি টান দিতেই ঝপাৎ করে শব্দ হলো। মাছ বেঁধেছে একটা। ইলশে তাইড়েল নাম। দেখতে যেমন সুন্দর, মাছটি খেতেও নাকি মজার। এরপর ট্যাংরা উঠল আরও কয়েকটি।
বিপ্লব কুমার বললেন, ‘আমরা বৈশেলরা মাছ ধরতে নামি মরা গোনে। ভরা গোনের সময় বড়শিতে মাছ হয় না। কারণ, ওই সময় স্রোত বেশি থাকে। মাছগুলো দাঁড়ায় না। আর মরা গোনে পানির চাপ কমে যায়। এ সময় পানির নিচে মাছগুলো দাঁড়ায়।’
গল্পে গল্পে সময় চলে গেলেও টের পাইনি। জোয়ারের স্রোত কমে এসেছে তখন। ওদিকে আকাশেও মেঘ জমেছে। আর দেরি না করে নৌকা ছাড়া হলো। লোকালয়ে পৌঁছে নৌকা থেকে নামতেই নামল ঝুম বৃষ্টি। নৌকা থেকে বিদায় নেওয়ার সময় জেলেরা জানালেন, সামনে ভাটিতে তাঁরা নেমে যাবেন সুন্দরবনের আরও গহিনে।