‘ঘরে খানেওয়ালা ১১ জন, একার রুজিতে সংসার চালাইতে কষ্ট হয়’

জুতা সেলাই ও কালির কাজ করছেন স্বপন চন্দ্র ঋষি। চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলা সদর বাজারের কলেজ রোডে। শুক্রবার বিকেলেছবি: প্রথম আলো

‘ঘরে খানেওয়ালা ১১ জন। রুজি করি আমি একাই। হারা দিন কাম কইরা পাই ৪০০ থিকা ৪৫০ টেয়া। প্রতিদিন কাম করি না, শরীর খারাপ থাকে। মাসে যেই টেয়া রোজগার করি, তা দিয়া সংসার চালাইতে খুব কষ্ট অয়। জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি। সংসারের খরচ নিয়া বিপাকে আছি। কোনোরকমে জান বাঁচাইতাছি।’

কথাগুলো বলছিলেন স্বপন চন্দ্র ঋষি (৩৫)। চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলা সদর বাজারের কলেজ রোডে ১৫ বছর ধরে ফুটপাতে জুতা সেলাই ও কালি করার কাজ (মুচির কাজ) করেন তিনি। তাঁর বাড়ি উপজেলার শীলমন্দি ঋষিপাড়া এলাকায়। ওই এলাকার সুবল চন্দ্র ঋষির ছেলে তিনি। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। স্ত্রী, মা-বাবা, পাঁচ ভাই ও দুই ছেলে নিয়ে তাঁর সংসার।

আজ শুক্রবার বিকেলে উপজেলা সদর বাজারের কলেজ রোডের ফুটপাতে স্বপন চন্দ্র ঋষির সঙ্গে কথা হয়। সেখানে বসে একমনে এক ব্যক্তির জুতা সেলাই ও পলিশ করছিলেন তিনি। কাজের ফাঁকে আলাপচারিতায় উঠে আসে সংসারের টানাপোড়েন, আর্থিক সমস্যা, বেঁচে থাকার লড়াইসহ তাঁর জীবনসংগ্রামের নানা কথা।

আরও পড়ুন

স্বপন চন্দ্র ঋষি বলেন, কিশোর বয়স থেকেই মুচির কাজ করছেন। তাঁর বাবাও এ কাজ করতেন। বাবার কাছ থেকেই কাজ শেখা। এখন তিনি ফুটপাতের যে জায়গায় (কথা টেলিকমের সামনে) বসে জুতা সেলাই ও কালি করছেন, তাঁর বাবাও এখানে বসেই কাজ করতেন। বয়স হওয়ায় তিনি এখন আর কাজ করেন না।

স্বপন বলেন, তাঁর ছোট এক ভাই কাঠমিস্ত্রির কাজ শিখছেন। আরেক ছোট ভাই বাজনা (ঢাক) বাজানোর কাজ শিখছেন। বাকিরা কিছুই করেন না। তাঁদের পৈতৃক জমিজমা নেই। ঘরে মা–বাবা, ৭ বছর ও ২ বছর বয়সী তাঁর দুই ছেলে। স্ত্রীসহ তাঁর পরিবারের সদস্যসংখ্যা ১১। সবার ভরণপোষণ তাঁকেই করতে হয়। প্রতিদিন সকাল সাতটায় ফুটপাতে বসেন। একটানা কাজ করার পর রাত আটটায় বাড়িতে ফেরেন। জুতা সেলাই, কালি ও পালিশ করে প্রতিদিন গড়ে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা রোজগার করেন। বৃষ্টি থাকলে কাজ বন্ধ থাকে। শরীর অসুস্থ থাকলে সেদিনও কাজে আসেন না। মাসে রুজি হয় ১০ থেকে ১১ হাজার টাকা। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেশি হওয়ায় সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়। এক-আধপেট খেয়ে কোনোমতে বেঁচে আছেন।

আরও পড়ুন

‘পরিবারের মুখে দুই মুঠা অন্ন জোগাইতে এত পরিশ্রম করতাছি। রোদ-বৃষ্টি কিছুই মানি না। কাম না করলে ঘরের সবাইরে না খাইয়া মরতে অইব। শরীরে নানা অসুখ। টেয়ার অভাবে চিকিৎসা করাইতে পারি না। এই শরীর নিয়াও কাম করি। যে টেয়া পাই, তা দিয়া সংসার চালাইতে কষ্ট অয়। কী করুম, গরিবের কপালে কষ্ট ছাড়া আর কী আছে!’ এভাবেই নিজের কষ্ট ও হতাশার কথা জানান স্বপন।

স্বপনের পাশে দাঁড়িয়ে কথা টেলিকমের দোকানি মো. রিপন বলেন, স্বপন কাজে খুব আন্তরিক। খুব কষ্ট করে সংসার চালাচ্ছেন। অসুস্থ শরীর নিয়েও জুতা সেলাইয়ের কাজ করছেন। হাল ছাড়ছেন না। সবার কাছ থেকে ন্যায্য পারিশ্রমিকও রাখছেন।

উপজেলার বাইশপুর এলাকার প্রাথমিক শিক্ষক হাসান মামুন বলেন, জুতা কালি করার জন্য তিনি প্রায়ই স্বপনের কাছে আসেন। ভালো করে, মন দিয়ে স্বপন কাজ করেন। প্রয়োজনের বেশি এক টাকাও রাখেন না। গরিব হলেও তিনি মানসিকভাবে সৎ ও দৃঢ়।