পতিত জমিতে কমলার বাগান করে সফল ইমরান

নিজের কমলাবাগানে ইমরান হোসেন। ২৫ নভেম্বর জয়পুরহাটের ভিকনী গ্রামেছবি: প্রথম আলো

চার বছর আগে ঢাকার সাভারে ইলেকট্রনিকস পণ্যের একটি ছোট দোকান চালাতেন ইমরান হোসেন। করোনাভাইরাসের কারণে ব্যবসায় লোকসান গুনতে হয়। বাধ্য হয়ে দোকান ছেড়ে গ্রামে ফিরে আসেন তিনি। বাড়িতে বসে থাকতে থাকতে তাঁর জমানো টাকাও শেষ হয়ে আসছিল, জমিজমার পরিমাণও কম। অল্প জমিতে প্রচলিত ধান ও আলু চাষাবাদের বিকল্প ভাবতে শুরু করেন। একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেন কমলার বাগান করবেন।

ইউটিউব ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে কমলার বাগান করার পদ্ধতি জেনে নেন ইমরান। এরপর কৃষি বিভাগে যোগাযোগ করেন। কৃষি কর্মকর্তারা তাঁকে কমলার বাগান করার বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তাঁকে কমলাগাছের চারাও নির্ধারণ করে দেন কৃষি কর্মকর্তারা। ইমরান তাঁর বাড়ির পাশে পতিত ৩০ শতাংশ জমিতে ১৭০টি বারি-২ জাতের কমলাগাছের চারা লাগান। সমতলে কমলাবাগান করা দেখে প্রথমে গ্রামের অনেকেই হাসিঠাট্টা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত পতিত জমিতে কমলার বাগান করে সফলতা পেয়েছেন ইমরান। এখন তিনি সফল কমলাচাষি।

ইমরান হোসেনের বাড়ি জয়পুরহাটের ভিকনী গ্রামে। ইমরানের স্ত্রী সুমী আক্তার কমলাবাগান পরিচর্যা করেন। এখন প্রায় প্রতিদিনই দূরদূরান্ত থেকে লোকজন কমলার বাগান দেখতে আসেন। ভিকনী গ্রামের বাসিন্দা আমজাদ হোসেন বলেন, তাঁদের গ্রামে কমলাবাগান আছে। এ জন্য অনেকেই তাঁদের গ্রামকে কমলার গ্রাম হিসেবে চেনেন।

আরও পড়ুন

গত ২৫ নভেম্বর ইমরানের কমলার বাগানে গিয়ে কমলাগাছের ডালে ডালে কমলা ঝুলতে দেখা যায়। বেশির ভাগ গাছের কমলায় কাঁচা সবুজ রং ছেড়ে সূর্যের আভার মতো রং এসেছে। ইমরান ও তাঁর স্ত্রী সুমি বাগান পরিচর্যা করছিলেন। সেখানে আলাপকালে ইমরান জানান, হঠাৎ একদিন অনলাইনে কৃষিবিষয়ক একটি ওয়েবসাইটে ঢুকে কমলাবাগান দেখেন। এর পর থেকে কমলাবাগান কীভাবে শুরু করবেন, সেই ধারণা নেন। বাড়ির পাশে পরিত্যক্ত জমিতে কয়েকটি কমলার গাছ রোপণ করেন। চারার জাত ভালো ছিল না। কিছুদিন পর লাগানো কমলার গাছগুলো নষ্ট হয়ে যায়। শুরুতেই কমলাবাগানে লোকসান গুনতে হয়েছে দেড় লাখ টাকা। তবে হাল ছাড়েননি।

আমরা স্বামী-স্ত্রী নিজেরাই কমলাবাগানের পরিচর্যা করি। এ বছর তৃতীয়বারের মতো বাগানে কমলা ধরেছে। বাগানে এসে গাছে গাছে কামলা দেখে প্রাণ জুড়ায়, তখন অতীতের কষ্ট ভুলে যাই।
সুমী আক্তার, ইমরানের স্ত্রী
কমলাগাছের ডালে ডালে কমলা ঝুলছে। ২৫ নভেম্বর জয়পুরহাটের ভিকনী গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

ইমরান বলেন, পরে একজন পরিচিত কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ওই কৃষি কর্মকর্তা বারি-২ জাতের কমলার চারা রোপণের পরামর্শ দেন। তিনি ১৭০টি বারি-২ জাতের কমলার চারা রোপণ করেন। প্রতিটি চারা ৬০০ টাকা করে কিনেছিলেন। তিনি কমলাবাগানে কোনো শ্রমিক নেননি। এরপর তাঁরা স্বামী-স্ত্রী দুজনে কমলাবাগানের পরিচর্যা শুরু করেন। ২০২২ সালে গাছগুলোতে প্রথম কমলা ধরে। সেই সময় প্রতিটি গাছে গড়ে ২৫-৩০ কেজি কামলা ধরেছিল। এবার তৃতীয়বারের মতো কমলা ধরেছে। গাছগুলোর বয়স বেশি হওয়ায় কমলার ফলন বেশি হয়েছে। আবার কমলার গায়ের রং টকটকে হয়েছে। প্রতিটি গাছে ৪০ থেকে ৪২ কেজি কমলা হয়েছে। ডিসেম্বর মাসের ১০-১২ তারিখে মধ্যে কমলা বিক্রির উপযুক্ত হবে।

ইমরানের স্ত্রী সুমী আক্তার বলেন, ‘আমরা স্বামী-স্ত্রী নিজেরাই কমলাবাগানের পরিচর্যা করি। এ বছর তৃতীয়বারের মতো বাগানে কমলা ধরেছে। বাগানে এসে গাছে গাছে কামলা দেখে প্রাণ জুড়ায়, তখন অতীতের কষ্ট ভুলে যাই।’

ইমরান বলেন, কমলাগাছের বয়স চার বছর হচ্ছে। এ বছর কমলাবাগানে তেমন একটা খরচ হয়নি। তবে পাঁচ লাখ টাকার ওপরে কমলা বিক্রি করবেন বলে আশা করছেন। প্রায় প্রতিদিন কমলাবাগান দেখতে লোকজন আসছেন। অনেকেই বাগান থেকে কমলা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইমরান হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ভিকনী গ্রামের ইমরান হোসেন ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে নিজ বাড়িতে এসে কমলার বাগান করেছেন। আগের তুলনায় কমলার ফলন অনেক বেশি হয়েছে। খরচও কম পড়েছে। কমলাগুলো কিছুদিনের মধ্যে পরিপক্ব হবে। এটি উপজেলার প্রথম কমলার বাগান। ইমরান কামলা চাষে বাজিমাত করেছেন। ইমরান যে জমিতে কমলার বাগান করেছেন, সেটি এক ফসলি জমি। এখান থেকে প্রচলিত চাষাবাদ করে বছরে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। সেই জমিতে ইমরান বছরে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা আয় করছেন। ইমরান কমলাচাষিদের মডেল।

আরও পড়ুন

জয়পুরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক রাহেলা পারভিন বলেন, সম্প্রতি তিনি ভিকনী গ্রামে ইমরানের কমলার বাগানে গিয়েছিলেন। অনেক পরিশ্রম করে ইমরান কমলাবাগানে সফলতা পেয়েছেন। যাঁরা বেকার রয়েছেন, তাঁরা ইমরানের কমলার বাগান দেখে উদ্বুদ্ধ হবেন, এটাই প্রত্যাশা করছেন।