রংপুরে কোরবানির পশুর হাট সরবরাহ পর্যাপ্ত, বিক্রি কম

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার বেতগাড়ি পশুর হাটে প্রচুরসংখ্যক গরু বিক্রির জন্য আনা হয়েছে । গতকাল তোলা ছবি।ছবি: প্রথম আলো

পবিত্র ঈদুল আজহা ঘনিয়ে এলেও রংপুরের কোরবানির পশুর হাটবাজারে বেচাকেনা জমে ওঠেনি। গরু-ছাগল বিক্রি হচ্ছে কম। এবার দামও বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। তবে হাটবাজারের ইজারাদার, খামারমালিক ও পশু বিক্রেতারা আশা করছেন, ঈদের কয়েক দিন আগে গবাদিপশুর বিক্রি বাড়বে।

তারাগঞ্জের মেনানগর গ্রামের খামারি সেকেন্দার আলী বলেন, ‘এবার বাজারে ক্রেতা কম। কিছুই বোজোছি না। ঈদ আসতে আর তো বাকি নাই। এই সময়ে প্রচুর গরু কেনাবেচা হতো।’

সয়ারবকশীপাড়া গ্রামের খামারি আবদুর রউফ জানান, চার মাস আগে কোরবানির হাটে বিক্রির উদ্দেশ্যে তিনি ১০টি গরু কিনেছিলেন। একেকটি গরুর (প্রতিটির ওজন আনুমানিক ১২০ কেজি) তখন দাম পড়েছিল ৮৫-৯০ হাজার টাকা। চার মাসে প্রতিটি গরুর পুষতে খাদ্যসহ সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে প্রায় ৩৬ হাজার টাকা। এতে একেকটি গরু কেনাসহ পুষতে এখন পর্যন্ত খরচ পড়েছে ১ লাখ ২১ হাজার থেকে ১ লাখ ২৬ হাজার টাকা। গত সোমবার তারাগঞ্জের কোরবানির হাটে চারটি গরু (প্রতিটির ওজন আনুমানিক ১৮৮ কেজি) তিনি বিক্রি করেছেন ১ লাখ ৩৬ হাজার থেকে ১ লাখ ৩৮ হাজার টাকায়। এতে দেখা যায়, গরুপ্রতি চার মাসে তিনি লাভ করেছেন ১০-১১ হাজার টাকা।

তারাগঞ্জের সবচেয়ে বড় পশুর হাট হচ্ছে তারাগঞ্জ হাট। এই হাটের ইজারাদার সহিদার রহমান বলেন, গত সোমবার তারাগঞ্জ হাটে কোরবানির গরু উঠেছিল দুই সহস্রাধিক, কিন্তু বিক্রি হয়েছে মাত্র ৪১৯টি। স্বাভাবিক সময়ে এই হাটে গড়ে ৩৫০টি বিক্রি হয়। গতবার ঠিক এই সময়ে গরু বিক্রি হয়েছিল আট শতাধিক গরু। এবারে কোরবানির হাটে গরুর দাম অনেকটা গত বছরের মতোই রয়েছে। হাটে গরু সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলেও এবারে এখন পর্যন্ত ক্রেতা কম।’

বদরগঞ্জ উপজেলার শাহাপুর গ্রামের খামারি হায়দার আলী বলেন, তাঁর খামারে গরু রয়েছে ১৫টি। কিন্তু খরচের তুলনায় এবারে দামটা কম হওয়ায় গরুগুলো ঈদের পর তিনি বেচবেন বলে জানান।

ওই গ্রামের আরেক খামারি সাদেকুল ইসলাম বলেন, ‘গত সোমবার ৫-৬ মণ ওজনের ২০ মাস বয়সের দুটি গরু বাড়ি থেকে বিক্রি করেছি ২ লাখ ৭৮ হাজার টাকায়। গরু ২টি ছিল বাড়ির। ২০ মাসে পুষতে খাদ্যসহ খরচ পড়েছিল প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এবারে খরচ অনুযায়ী কোরবানিতে গরুর বাজার কম। হাটে ক্রেতাও কম।’

বদরগঞ্জ পৌরসভার হাসপাতালপাড়া গ্রামের মোকাররম হোসেন বলেন, ‘কোরবানির দেওয়ার উদ্দেশ্যে কেনা গরুর ওজন দেখতে নেই। তবু আনুমানিক ৯০ কেজি ওজনের কোরবানির একটি গরু কিনেছি ৬৬ হাজার টাকায়। দামটা এবারে কম মনে হচ্ছে।’

গঙ্গাচড়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সাখাওয়াৎ হোসেন ওই তথ্য দিয়ে বলেন, উপজেলায় এবারে কোরবানির পশুর সরবরাহ পর্যাপ্ত রয়েছে।

গঙ্গাচড়া উপজেলার খামারি সুজন আহম্মেদ বলেন, কোরবানির জন্য সাতটি গরু তিনি প্রস্তুত করেছেন। প্রতিটি গরুর পেছনে সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার টাকা। কিন্তু দাম কম হওয়ায় তিনি গরুগুলো এখনো বাজারে ওঠাননি।’

গঙ্গাচড়ার আরেক খামারি মিলন মিয়া বলেন, তিনি কোরবানির উপযোগী সাতটি গরু পুষে ইতিমধ্যে তিনটি বিক্রি করে দিয়েছেন। খরচ বাদ দিয়ে ওই তিন গরুতে তাঁর লাভ হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা।

রংপুরের পীরগাছা উপজেলার কৈকুড়ি চালুনিয়া গ্রামের খামারি সাইফুল ইসলাম জানান, তাঁর খামারে কোরবানির উপযোগী ৩০টি দেশি গরু রয়েছে। এর মধ্যে ইতিমধ্যে তিনি ১০টি গরু বিক্রি করে পেয়েছেন ১১ লাখ টাকা। তিনি বলেন, ‘এখনো লাভের পরিমাণটা হিসাব করিনি। তবে খাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় লাভের পরিমাণটা অনেক কম হবে।’ তিনি আরও বলেন, গত বছর কোরবানিতে ৩০টি গরু পুষে বিক্রি করে লাভ করেছিলেন অন্তত ৮ লাখ টাকা।

বদরগঞ্জ প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের উপসহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (প্রাণী স্বাস্থ্য) মো. আবদুল কাদের বলেন, কোরবানির পশু আগাম কিনে রাখার ঝামেলা অনেকে নিতে চান না। আবার কিনে রাখলে খাদ্য খাওয়াতে খরচ বাড়ে। এ কারণে অনেকে শেষ পর্যায়ে কোরবানির পশু কিনে থাকেন।

রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় খামারির সংখ্যা ২৫ হাজার। এবারে কোরবানির জন্য পশু প্রস্তুত রয়েছে ৩ লাখ ৫৯ হাজার। জেলায় চাহিদা হচ্ছে ২ লাখ ২০ হাজার। উদ্বৃত্ত রয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার পশু।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা এনামুল হক বলেন, জেলার চাহিদা মিটিয়ে কোরবানিযোগ্য উদ্বৃত্ত ১ লাখ ৪০ হাজার পশু দেশের অন্যত্র বিক্রি করা হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে বোরো ধান কাটা-মাড়াই নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকেরা। অনেকে ধারদেনা করে আবাদে লাগিয়ে ধান বেচে তা পরিশোধ করছেন। সামনে আমন মৌসুমের খরচ জোগাতে আগাম চিন্তায় দিন কাটছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সংসার পরিচালনায় কৃষকসহ সাধারণ মানুষ হিমশিম পোহাচ্ছেন। এ কারণে অনেকেই কোরবানির চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিয়েছেন।

তারাগঞ্জের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের কৃষক খবির উদ্দিন বলেন, ‘প্রতিবছর একটা করি গরুত ভাগ (কোরবানি) দেছনো। এবার তা পারোছি না। ধান বেচেয়া ইন (ঋণ) শোধ করছি। ফির আবাদ কইরবার নাগবে। এবার সংসার চলাটায় মুশকিল হইছে।’