২০২১ সালের জানুয়ারির কথা। ২০ জন নারী একত্র হয়েছিলেন উপজেলা পরিষদের একটি প্রশিক্ষণে। সেখান থেকেই পান অনুপ্রেরণা। সবাই মিলে নতুন কিছু করার দিশা খুঁজে পান যেন। ৯ মাস ধরে চলে পরিকল্পনা। পরের বছরের জানুয়ারিতে গড়ে তোলেন একটি সমবায় সমিতি। সেখানে নারীদের জন্য তৈরি হয় স্যানিটারি ন্যাপকিন। এই ২০ নারী মিলে বানান দামে সস্তা ও মানসম্মত ন্যাপকিন। নিজেরাই সেই ন্যাপকিন বাজারজাত করেন। টানা এক বছর লাভ তো দূরে থাক, লোকসান গুনতে হচ্ছিল। কিন্তু কিছুতেই পিছু হটেননি। লক্ষ্যে অবিচল থাকার ফল পেয়েছেন তাঁরা। কয়েক মাস ধরে ন্যাপকিনের চাহিদা বেড়েছে। বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক ছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিশোরীদের ব্যবহারের জন্য নেওয়া হচ্ছে এই ২০ নারীর বানানো স্যানিটারি ন্যাপকিন। যাচ্ছে আশপাশের জেলায়ও।
এই নারী উদ্যোক্তাদের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী পৌর শহর ও আশপাশের এলাকায়। নিজেদের গড়ে তোলা সমবায় সমিতির নাম দিয়েছেন ‘ইচ্ছে’। সেখানে আরও ১০ নারীকে কাজ দিয়েছেন তাঁরা। সংসারের কাজ সামলে সমিতিতে সময় দেন সবাই। সপ্তাহের ছয় দিন কাজ চলে।
সভা থেকে শুরু
উপজেলা পরিষদের সেই প্রশিক্ষণ ছিল স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরির প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ শেষে নারীরা মিলে একটি সভা করেন। সেই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, নিজেরাই ব্যবসা করবেন। সেখানে নিজেরাই শ্রম দেবেন। চলতে থাকে তাঁদের প্রস্তুতি। প্রতি মাসে এক হাজার টাকা মাসিক চাঁদা দেন সবাই।
একই বছরের ডিসেম্বরে চাঁদার টাকায় ‘ইচ্ছে মহিলা সমবায় সমিতি লিমিটেড’ গড়ে তোলেন। এরপর পল্লী উন্নয়ন সঞ্চয় ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে এক লাখ টাকা ঋণ তোলেন। ন্যাপকিন তৈরির কাজ শুরু হয়। ঢাকা থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম আসে। শহরের মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় তলায় চারটি কক্ষ ভাড়া নেন। সেখানে নয়টি সেলাই মেশিন স্থাপন করেন।
সংগঠনের সভাপতি মেরিনা আক্তার বলেন, তাঁদের অনেকেই সংগঠনের ভিন্ন ভিন্ন নাম প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু ইচ্ছে নামটা সবার পছন্দ হয়। এরপর প্যাকেটের লোগোও তাঁরা তৈরি করেন। শুরুর দিকে থাকা পাঁচজন ছিটকে গেলেও আরও পাঁচজন পরে যুক্ত হয়েছেন।
নিজেরা সারা দিন ন্যাপকিন তৈরির কাজ করেন। দিন ভাগ করে নিজেরাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও দোকানে ছুটে যান নিজেদের তৈরি পণ্যের প্রচারে। শুরুর দিকে তেমন সাড়া পাননি। বাড়ি থেকে তাঁদের অনেককে নেতিবাচক কথা শুনতে হয়েছে।
উদ্যোক্তা শাহনাজ পারভীন বলেন, ‘আমাদের মনে জেদ চলে আসে। হারা যাবে না।’ নিজেদের প্রতিষ্ঠানের স্লোগান ‘নারী শক্তি’। সেই শক্তি নিয়ে কাজ চালিয়ে যান। পণ্য প্রচারের কাজে বেশি মনোযোগী হন। বর্তমানে কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ও খুলনায় সরবরাহ করা হচ্ছে।
কয়েক মাস ধরে লাভের মুখ দেখা শুরু করেছেন, জানালেন কয়েকজন উদ্যোক্তা। শ্রমিকদের বেতন দিচ্ছেন। নিজেরাও লভ্যাংশ পাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানেও লভ্যাংশের একটা অংশ জমা রাখছেন।
মেয়েদের মাসিকের সময় জীবাণুমুক্ত কাপড় ব্যবহার খুবই জরুরি উল্লেখ করে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এ এস এম মুসা কবির প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে সচেতন করতে সবাইকে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে এ ধরনের স্যানিটারি ন্যাপকিন বানানো ও বাজারজাতের উদ্যোগ প্রশংসনীয়।
নারীদের কাজের প্রশংসা
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, এক কক্ষে বসে নারীদের কেউ তুলা কাটছেন, কেউ সেগুলো নেটের ভেতর ভরে রোল বানাচ্ছেন। আরেক কক্ষে কেউ বসে রোলের দুই প্রান্তে ফিতা সেলাইয়ের কাজ করছেন। সেলাইয়ের পর সেগুলো পাশের কক্ষে জীবাণুমুক্তকরণের কাজ চলে। এরপর প্যাকেটিং।
জীবাণুমুক্তকরণ কাজটি কিভাবে হয় সে সম্পর্কে জানালেন এক নারী। ন্যাপকিন তৈরির পর অটোক্লেভ মেশিনের সাহায্যে কাজটি করেন তাঁরা। যন্ত্রটির নিচের দিকে পানি ঢালা হয়। উপরের ট্রেতে নির্দিষ্ট পরিমাণ ন্যাপকিন রাখা হয়। তারপর যন্ত্রের মুখ আটকে দেওয়া হয়। ২০ থেকে ৩০ মিনিট পানি গরম করা হয় এবং সে পানি বাষ্পীভূত হয়। সঙ্গে ন্যাপকিনগুলো জীবাণুমুক্ত হয়ে যায়। পরে সেগুলো মোড়কজাত করা হয়।
স্নাতক পাসের পর বেকারই বসে ছিলেন রুপালী খাতুন। বললেন, ‘এখানে কাজ করে খুব ভালো লাগছে। ঘরে বসে থাকার চেয়ে কাজ করে খেতে পারছি।’
সংগঠনটির নারী উদ্যোক্তারা বলছেন, বেকারত্ব কমাতে, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দেশের অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করতে তাঁরা স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন। বর্তমানে ৩০ জন নারী সেখানে ন্যাপকিন তৈরির কাজ করছেন। প্রতি মাসে তাঁরা ৩ থেকে ৪ হাজার ন্যাপকিন তৈরি করছেন। প্রতি প্যাকেট (১০টি) ৫০ টাকায় পাইকারি ও খুচরায় বিক্রি করছেন তাঁরা। বাজারের অন্য ন্যাপকিনের তুলনায় যা অর্ধেক দামে পাওয়া যায়।
কুমারখালী ফ্যামিলি কেয়ার হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক সুজয় চাকী বলেন, ইচ্ছে স্যানিটারি ন্যাপকিন অন্যগুলোর চেয়ে অধিক শোষণক্ষমতার এবং দাম কম। সে জন্য তাঁর প্রতিষ্ঠানের রোগীদের এটাই ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি।
নারী উদ্যোক্তার কাজ নিজে দেখেছেন এবং তাঁদের কাজের প্রশংসা করে কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিতান কুমার মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, এই নারী উদ্যোক্তাদের পণ্যের প্রচার ও প্রসারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।