মৌলভীবাজারে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মাঠে ঢেউ খেলছে আমন ধান, আশাবাদী কৃষকেরা
মৌলভীবাজারে আউশ ও আমনের অনেক ফসলের মাঠ মনু ও ধলাই নদের বন্যার পানিতে এবার তলিয়ে গিয়েছিল। অনেক খেতে আমনের রোপণ করা চারা পচে নষ্ট হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছিল, এসব জমিতে চলতি মৌসুমের আমনের চাষ সম্ভব হবে না। কিন্তু কৃষকের উদ্যোগে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত খেতেই আমন ধানের চাষ হয়েছে। সেসব জমিতে এখন ঢেউ খেলছে সবুজ ধানগাছ।
মৌলভীবাজার জেলার বন্যাকবলিত রাজনগর, কমলগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকাতেই এখন এমন সবুজের মাঠ হেমন্তের রোদে ঝলমল করছে। তবে আশঙ্কা হচ্ছে, বিলম্বিত চাষে ফসলের উৎপাদন লাভজনক হয় কি না। এ ধরনের প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর জমির আমন ধান পর্যবেক্ষণে রেখেছে স্থানীয় কৃষি বিভাগ। তবে চলতি বছর বন্যার কারণে প্রায় তিন হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়নি। তাই জেলায় আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, রাজনগর উপজেলার মনসুরনগর ইউনিয়নের কদমহাটা, ধাইসার, তাহারলামুসহ বিভিন্ন এলাকার বন্যাকবলিত মাঠে সবুজ ধানের গাছ হেমন্তের মৃদু বাতাসে ঢেউ খেলছে। কিছু কিছু খেতে বেরিয়েছে ধানের শিষ, কোনোটিতে আবার পুষ্ট হয়ে উঠছে ধানের ছড়া। জেলার কৃষি বিভাগ জানায়, পানিতে কয়েক দিন তলিয়ে থাকার পরও আগাম জাতের বিনা-১৭ ও ৭, ব্রি ধান-৭১, ৭৫ সহ কিছু জাত টিকে থাকতে পারে।
স্থানীয় কৃষকেরা বলেন, ধাইসারসহ আশপাশের অনেক খেতের রোপণ করা ‘হালিচারা’ দু-তিন দিন মনু নদের পানিতে তলিয়েছিল। তাঁরা ধারণা করেছিলেন, এসব ধানগাছ নষ্ট হয়ে যাবে, আর মাথা তুলে দাঁড়াবে না। কিন্তু পানি নেমে যাওয়ার পর কিছুদিনের মধ্যে দেখা গেছে ধানগাছ মরে যায়নি। ধীরে ধীরে ধানের চারার গোড়া থেকে কুশি বের হচ্ছে। সেই সঙ্গে ধানের গোছাও বড় হচ্ছে।
কৃষক হুমায়ূন বলেন, কিছু খেতের রোপণ করা হালিচারা পানির স্রোতে ভেসে গিয়েছিল। কৃষকেরা হালিচারা সংগ্রহের পর সেসব শূন্য স্থানে নতুন করে চারা রোপণ করেছেন। আবার কিছু জমি তুলনামূলক নিচু হওয়ায় সেসব জমির ধানের চারা পুরোপুরিভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। এসব জমিতে সম্পূর্ণ নতুনভাবে হালিচারা কিনে রোপণ করা হয়েছে। এতে খরচও দ্বিগুণ হয়েছে। বন্যার আগে এক কিয়ার (৩০ শতক) জমিতে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু বন্যার কারণে সেই জমিতে প্রায় আট হাজার টাকা খরচ পড়েছে।
কৃষি বিভাগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বন্যা–পরবর্তী সময়ে কৃষকের পক্ষে নতুনভাবে বীজতলা তৈরিসহ আবার রোপণ কঠিন হয়ে পড়ে। এরপরও অনেক কৃষক আমনের চারা সংগ্রহ করে রোপণ করেছেন। এতে কৃষকদের বাড়তি টাকা খরচ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কৃষকেরা বিলম্বিত চাষে কতটুকু ফসল হবেন, তা বিবেচনা করেননি। তবে কাউয়াদীঘি হাওরাঞ্চলে এবার আমন চাষ ব্যাহত হয়েছে।
কাউয়াদীঘি হাওর মৌলভীবাজার সদর উপজেলার দুটি ও রাজনগর উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে বিস্তৃত। এবার রাজনগরে মনু নদের একাধিক স্থানে বাঁধ ভেঙে সেই পানি কাউয়াদীঘি হাওরে প্রবেশ করে। একদিকে বৃষ্টি ও অন্যদিকে বন্যার পানি জমাট বেঁধে কাউয়াদীঘি হাওর পারে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। মনু নদ সেচ প্রকল্পের আওতায় কাউয়াদীঘি হাওরের বাড়তি পানি নিষ্কাশন করার জন্য স্থাপিত পাম্প হাউসের মাধ্যমে সেচ দেওয়া হয়েছে। এতে পানি কিছুটা কমলেও আমন ফসলের মাঠ চাষের উপযোগী হয়ে ওঠেনি।
এবারের বন্যায় জেলার ১৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে বলে জানায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজার জেলা কার্যালয়। সূত্রটি জানায়, এর মধ্যে প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে আবার চারা রোপণ করা হয়েছে। এ ছাড়া জলাবদ্ধতার কারণে কাউয়াদীঘি হাওরাঞ্চলে আমনের চাষাবাদ না হওয়ায় প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়নি। এবার সারা জেলায় আমনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ১ হাজার হেক্টর। চাষাবাদ হয়েছে প্রায় ৯৮ হাজার হেক্টর।
এ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজারের উপপরিচালক কৃষিবিদ সামছুদ্দিন আহমেদ আজ শনিবার প্রথম আলোকে জানান, ফসল হয়েছে। কৃষকেরা অনেক ধৈর্যশীল। বীজ ও চারা সংগ্রহ করে চাষ করেছেন। তবে বিলম্বে রোপণ করা ১৪ হাজার হেক্টর জমি আলাদাভাবে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। মাঠ সবুজ হয়েছে। কিন্তু ধান কী পরিমাণ হবে, কতটুকু পুষ্ট হবে, চিটা হয় কি না, ফলন লাভজনক হয় কি না, ফসল এলে এসব বোঝা যাবে। ফসল পাকতে আরও এক মাসের বেশি সময় লাগতে পারে।