মাদারীপুরে দুদিনের জন্য বসছে ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলা, তবে ইজারা বাতিল

মেলা বন্ধ ঘোষণার পর সমালোচনা ছড়িয়ে পড়লে মেলার বিপক্ষের লোকজনসহ রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে জরুরি সভা করে জেলা প্রশাসন। শনিবার বিকেলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়েছবি: সংগৃহীত

মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলায় দীপাবলি ও কালীপূজা উপলক্ষে প্রায় আড়াই শ বছরের ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলা ঘিরে আলোচনা-সমালোচনার পর প্রাথমিকভাবে দুই দিনের মেলার অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা প্রশাসন।

আজ শনিবার বিকেলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মেলার বিপক্ষের লোকজনসহ ইসলামী দলের নেতা–কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে প্রাথমিকভাবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কাল হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ও মেলার পক্ষের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এর আগে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তির আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে মেলার আয়োজন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল উপজেলা প্রশাসন।

কালকিনি পৌরসভার প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উত্তম কুমার দাশ সন্ধ্যায় বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘ডিসি স্যারের মিটিংয়ে ঐতিহ্যবাহী এই মেলা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। দুই দিনের জন্য মেলা চলার অনুমতি স্যার দেবেন। তবে পৌরসভা থেকে যাঁকে ইজারা দেওয়া হয়েছে, সেটি বাতিলই থাকছে। যারা কালীপূজার আয়োজন করেছে, মেলাটি তারাই পরিচালনা করবে। রোববার জেলা প্রশাসন থেকে মেলাটি পরিচালনাসহ সার্বিক সব বিষয় লিখিত জানানো হবে।’

উপজেলা প্রশাসন, আয়োজক ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৩১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব দীপাবলি ও কালীপূজা। এই উৎসব ঘিরে কালকিনি উপজেলার ভূরঘাটা এলাকায় ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ি মেলার আয়োজন করা হয়। প্রায় ২৫০ বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী এই মেলা অনুষ্ঠিত হলেও এবার স্থানীয় ১২ জন ব্যক্তি ৯টি কারণ উপস্থাপন করে মেলাটি বন্ধের দাবি জানান। পরে কালকিনি পৌরসভা ও উপজেলা প্রশাসন সভা করে গত বৃহস্পতিবার মেলা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।

সূত্রে জানা গেছে, গত ১ এপ্রিল পৌরসভার পক্ষ থেকে ৮০ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যে আকবর হোসেন সরদার নামের আওয়ামী লীগের এক নেতাকে মেলা আয়োজনের ইজারা দেওয়া হয়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে আওয়ামী লীগের নেতার ওই ইজারা বাতিলের দাবি জানায় একটি মহল। পরে সেটি করতে ব্যর্থ হলে তারা ৯টি কারণ দেখিয়ে মেলা পুরোপুরি বন্ধ করতে কালকিনি পৌরসভা ও প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ জানায়। পরে প্রশাসন অনেকটা চাপের মুখেই মেলাটি বন্ধের নির্দেশনা দেয়।

মেলা বন্ধের ঘোষণা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তীব্র আলোচনা-সমালোচনার মুখে পড়ে প্রশাসন। পরে মেলাটি চালুর ব্যাপারে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা-কর্মীরা জেলা প্রশাসক মোছা. ইয়াসমিন আক্তারের কাছে জানান। এরপর জেলা প্রশাসক নিজ কার্যালয়ে মেলার বিপক্ষের লোকজনসহ রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে জরুরি সভার আয়োজন করেন। সভায় কালীপূজার পাশাপাশি মেলাটি দুই দিনের জন্য পরিচালনা করার ব্যাপারে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কাল রোববার হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত নেওয়া হবে।

সভায় অংশ নেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলা শাখার সভাপতি আজিজুল হক মল্লিক। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, পূজা নিয়ে তাঁদের আপত্তি নেই। মেলা নিয়ে তাঁদের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের আপত্তি থাকায় তাঁরা অভিযোগ দেন। বিষয়টি তাঁরা জানতেন। মেলা নিয়ে জেলা প্রশাসক বিকেলে তাঁদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন। সভায় তাঁরা মেলার বিপক্ষে ছিলেন। সভায় মন্দিরের লোকজন তিন দিনের পূজার কথা জানিয়েছেন। পূজার সঙ্গে মেলার সম্পর্ক নেই বলেও জানিয়েছেন। সবকিছু জেলা প্রশাসক নোট করেছেন। সব শুনে জেলা প্রশাসক যদি মেলার অনুমতি দেন, সেটা তাঁর এখতিয়ারের মধ্যে দেবেন।

আরও পড়ুন

সভায় অংশ নেওয়া জামায়াতে ইসলামীর জেলা আমির আব্দুস সোবহান প্রথম আলোকে বলেন, সভায় প্রশাসন বাদে যারা ছিলেন, বেশির ভাগই মেলার বিপক্ষে মত দিয়েছেন। তাঁরা জেলা প্রশাসককে উভয় পক্ষের কথা শুনে যেটা সুন্দর হয়, সেই সিদ্ধান্ত নিতে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘মেলার সরাসরি বিপক্ষে আমরাও নই। এখানে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা বিষয় জড়িত। অনেকে অনেক আশা নিয়ে মেলার জন্য অপেক্ষা করেন। সবকিছু মিলিয়ে সুন্দর পরিবেশে যদি মেলাটি হয় তাহলে কারও কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। প্রশাসন যদি কঠোর ও নিরপেক্ষভাবে সবকিছু দেখে সেটাই সবার কাম্য।’

জানতে চাইলে ভূরঘাটা কুন্ডুবাড়ি কালীপূজা উদ্‌যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিমল কুন্ডু প্রথম আলোকে বলেন, ‘কালীপূজা ঘিরেই মেলায় নিত্যপ্রয়োজনীয় সব ধরনের জিনিসপত্র ওঠে। হাজারো দোকানপাট বসে। লাখো মানুষের সমাগম ঘটে। এটি দক্ষিণাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী মেলা। মেলা বন্ধ করতে রাতের আঁধারে কিছু লোক ব্যানার টাঙিয়ে মেলা বন্ধের ঘোষণা দিয়ে যায়। এটা দেখে আমরা অবাক হয়েছিলাম। তবে সর্বশেষ প্রশাসন মিটিংয়ে আশ্বাস দিয়েছে যে মেলা চলবে। তারা দুই দিন মেলা চলানোর অনুমতি দেবে। এ জন্য আমাদের মেলার অনুমতির জন্য লিখিত আবেদন দিতে বলেছে।’

মাদারীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মেলা নিয়ে যাঁরা আপত্তি জানিয়েছিলেন, তাঁদের নিয়ে আজ জেলা প্রশাসনের সভা হয়েছে। সভায় দুই দিন মেলা চলবে সেটি নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কাল রোববার মেলার আয়োজকদের সঙ্গে সভা হবে। তারপর লিখিত অনুমতি দেওয়া হবে।