উত্তরের ‘সাগর’ আর ‘সুন্দরবন’ দেখতে যেতে পারেন দিনাজপুর
‘ওরে বাংলাদেশের মানুষগিলা থাকিল তোমহার নিমন্তন, দিনাজপুর ভাই বেড়েয়া যান। ওরে কান্তনগর-সুখসাগর, রাজবাটি আর রামসাগর দেখিলে ভাই জুড়ায় যাবে প্রাণ।’ দিনাজপুরের স্থানীয় কবি আমজাদ আলীর এই গানের মধ্য দিয়েই জেলার সৌন্দর্য ও রূপ বর্ণনার পরিচয় মেলে।
উত্তরের এই জনপদে আছে রাজা-মহারাজাদের স্মৃতি বহনকারী রাজবাটি, মনুষ্যসৃষ্ট সাগর, ঐতিহাসিক কান্তজিউ মন্দির, নয়বাদ মসজিদ, সুরা মসজিদ, শাল-সেগুনের বন। বনের ভেতর এলোমেলো পথে খুঁজে পাবেন সুনসান নীরবতা। উইপোকার দালান দেখার পাশাপাশি কানে তুলবেন পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ।
দিনাজপুর রাজবাটি
দিনাজপুর শহরের উত্তর-পূর্বে রাজারামপুর গ্রামে রাজবাটির অবস্থান। পঞ্চদশ শতাব্দীতে রাজা দিনারাজ ঘোষ এই রাজবাটি নির্মাণ করেন। পলাশী যুদ্ধের প্রায় আট বছর পর ইংরেজরা রাজবাটিতে তাঁদের প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু করেন। ধারণা করা হয়, দিনারাজ নামের ওই রাজার সম্মানার্থেই পরে ব্রিটিশরা জেলার নাম রাখেন দিনাজপুর। সেটি ১৭৮৬ সালের কথা।
কয়েক শ বছরের পুরোনো রাজবাটির সেই জৌলুশ থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাজবাটির ইতিহাসসমৃদ্ধ ভবন, যেমন কুমারমহল, আয়নামহল, রানিমহল, লক্ষ্মীর ঘর, আটচালা ঘর, ঠাকুরঘর, কালিয়া জিউ মন্দির আঁতুড়ঘর, রানিপুকুর, চম্পাতলা দিঘি এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ভবনগুলোর ইট-চুন-সুরকি আর প্রাচীন বটবৃক্ষ ভ্রমণপিপাসু কিংবা ইতিহাসপ্রেমীদের সরবে জানান দেয় ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর কথা। চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে উঠবে রাজা-মহারাজাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের চিত্র।
এক উপজেলাতেই দেখবেন পাঁচ সাগর
দিনাজপুর শহর ঘেঁষে পাঁচটি সাগর। সাগরের কথা মনে ভাসতেই সৈকতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শো শো আওয়াজ কানে অনুভূত হয়। তবে দিনাজপুরের কক্সবাজারখ্যাত সাগরপাড়ে সেই আওয়াজ নেই। আছে নৈঃশব্দ্যের সঙ্গে বাহারি পাখির কুজন। বছরের প্রায় সব সময়ই এসব সাগরপাড়ে কমবেশি পর্যটক ও দর্শনার্থীরা আসেন সাগরের স্বচ্ছ নীল জল দেখতে। সাগরগুলো হলো রামসাগর, শুকসাগর, মাতাসাগর, আনন্দসাগর ও জুলুমসাগর। সাগরগুলো নিয়ে স্থানীয় মানুষের মধ্যে নানা জনশ্রুতিও আছে। কারও মতে, প্রচণ্ড খরা থেকে রক্ষা পেতে প্রজাদের জন্য রাজা সাগর খনন করেছিলেন। কেউ বলেন, অলৌকিকভাবে সাগরগুলো তৈরি হয়েছে।
দিনাজপুর শহর থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দূরে আউলিয়াপুর ইউনিয়নের তাজপুর গ্রামে রামসাগরের অবস্থান। এর দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৩৬ মিটার আর প্রস্থ গড়ে ২৩৬ মিটার। এর পাড়ে আম, জাম, কাঁঠাল, সেগুন, আমলকী, হরীতকী, দেবদারু, জারুল, কাঞ্চন, নাগেশ্বর, কাঁঠালিচাঁপা, বটসহ ১৫২ রকমের গাছ দাঁড়িয়ে আছে। রয়েছে হরেক রকমের ফুলগাছ। পলাশী যুদ্ধের কিছুকাল আগে দিনাজপুরের রাজা প্রাণনাথ এই সাগর খনন করিয়েছিলেন। তাঁর শাসনামলে একবার অনাবৃষ্টি ও খরা হয়েছিল। তারপরই রাজা এই সাগর খননের উদ্যোগ নেন। শীতকালে অনেক পরিযায়ী পাখি আসে এখানে। রামসাগরের পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে সুন্দর একটি দ্বিতল ডাকবাংলো। বাংলোর গেট থেকে বের হয়ে হাতের বাঁয়ে বনলতার দরজা। সেই দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়বে মিনি চিড়িয়াখানা। কাউকে দেখলে দৌড়ে আসে হরিণের পাল। চিড়িয়াখানা থেকে বের হয়ে হাতের বাঁ পাশে রামসাগর শিশুপার্ক। প্রতিবছর মাঘ মাসের পঞ্চমী তিথিতে এখানে বসে বারুণী মেলা।
এ ছাড়া শহরের রাজবাটি–সংলগ্ন শুকসাগর ও মাতাসাগরের অবস্থান এবং শহরের পশ্চিম প্রান্তে জুলুমসাগর পূর্বে রয়েছে আনন্দসাগর। সকালে কিংবা বিকেলে এসব সাগরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন দর্শনার্থীরা। স্বচ্ছ পানি থেকে ধবধবে সাদা বক মাছ ধরে উড়ে যায়। দল বেঁধে আকাশে ভেসে বেড়ায় পরিযায়ী পাখি। প্রতিটি সাগরপাড়ে রয়েছে নানা রকমের গাছপালা। প্রায় সব কটি সাগরপাড়ে ছোট ছোট টংদোকান ঘিরে নির্মল আড্ডার সুযোগ মিলবে। সাগরপাড়ে বনভোজন কিংবা চড়ুইভাতির আয়োজনও করেন ভ্রমণপিপাসুরা।
কান্তজিউ মন্দির
কান্তজিউ মন্দির বাংলাদেশের বিখ্যাত ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর একটি। এ জেলায় বেড়াতে এসেছেন, কিন্তু কান্তজিউ মন্দির ঘুরে দেখেননি—এমন মানুষের সংখ্যা কম। দিনাজপুর শহর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে ঢেপা নদীর তীর ঘেঁষে কান্তনগর গ্রামে মন্দিরের অবস্থান। অনেকে এটিকে নবরত্ন মন্দির হিসেবেও জানেন। মন্দিরের শিলালিপি অনুযায়ী, ১৮ শতকের দিকে মহারাজা প্রাণনাথ মন্দিরের নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন। নির্মাণকাজ চলমান অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। পরে ১৭৫২ সালে এর নির্মাণকাজ শেষ করেন তাঁর ছেলে মহারাজা রামনাথ রায়।
তিনতলাবিশিষ্ট কান্তজিউ মন্দিরের উচ্চতা ৭০ ফুট। মন্দিরের বাইরের দেয়ালজুড়ে প্রায় ১৫ হাজার টেরাকোটার টালিতে রামায়ণ, মহাভারতের পাশাপাশি মুঘল আমলে বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ছবি চিত্রিত করা আছে। মন্দির প্রাঙ্গণ আয়তাকার হলেও পাথরের ভিত্তির ওপরে দাঁড়ানো সুউচ্চ মন্দিরটি বর্গাকার। মন্দিরের পাশে আছে কান্তনগর জাদুঘর। এখানে শিব, বিষ্ণুমূর্তির পাশাপাশি রয়েছে প্রাচীন নানা শিলালিপি।
নয়াবাদ মসজিদ
কান্তজিউ মন্দির থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরত্বে নয়াবাদ মসজিদ। জনশ্রুতি আছে, মহারাজা প্রাণনাথ মন্দির নির্মাণের জন্য পারস্য থেকে কিছু স্থপতি ও নির্মাণশ্রমিক এনেছিলেন, যাঁরা ছিলেন মুসলিম ধর্মাবলম্বী। মহারাজার পরামর্শে মন্দিরের অদূরে ওই নির্মাণশ্রমিকেরা মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদের পাশেই বসবাস শুরু করেন। সেই থেকে গ্রামের নাম হয়েছে নয়াবাদ মিস্ত্রিপাড়া।
মসজিদটির দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ৪৫ মিটার এবং প্রস্থ ৫ দশমিক ৫ মিটার। তিন গম্বুজবিশিষ্ট আয়তাকার মসজিদের চার কোনায় রয়েছে অষ্টভুজাকৃতির চারটি মিনার। মসজিদের গায়ে রয়েছে ফুল ও লতাপাতার ফলক। মূলত কান্তজিউ মন্দির ও নয়াবাদ মসজিদ যেন একই সূত্রে গাঁথা দুটি ঐতিহাসিক স্থাপনা।
সুরা মসজিদ
এ অঞ্চলে মুসলিম স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন সুরা মসজিদ। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা চত্বর থেকে তিন কিলোমিটার পশ্চিমে হিলি-ঘোড়াঘাট সড়কের চৌগাছা এলাকায় দেখা মিলবে মসজিদটির। দৃষ্টিনন্দন এ মসজিদের নির্মাণশৈলী দেখতে প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থী আসেন এখানে। এটি সুরা মসজিদ, সৌর মসজিদ, শাহ সুজা মসজিদ নামেও পরিচিতি পেয়েছে।
মসজিদের কারুকাজ ও স্থাপত্যশৈলী দেখে ধারণা করা হয়, ষোড়শ শতকে সুলতানি আমলে হোসেন শাহির শাসনকালে এটি নির্মাণ করা হয়। বারান্দাসহ মসজিদের দৈর্ঘ্য ৪২ ফুট এবং প্রশস্ত ২৬ ফুট। চার ফুট উঁচু মজবুত প্ল্যাটফর্মের ওপরে মসজিদের মূল কাঠামো। মোট ৪টি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের গায়ে ফুল, লতাপাতা ও ঝুলন্ত শিকলের টেরাকোটা রয়েছে।
সিংড়া শালবন-নবাবগঞ্জ জাতীয় উদ্যান-কালিয়াগঞ্জ শালবন
দিনাজপুরের সিংড়া শালবনে পাতাঝরা শালবৃক্ষেরই আধিক্য। তবে শাল ছাড়াও এই বনে রয়েছে জারুল, তরুল, শিলকড়ই, শিমুল, মিনজিরি, সেগুন, গামারি, আকাশমণি, ঘোড়ানিম, সোনালু, গুটিজাম, হরীতকী, বয়রা। রয়েছে টগর, জুঁই, বনবেলী, হৈমন্তী ফুল। দেখা মিলবে শতমূল, অনন্তমূল, গুলঞ্চ, যষ্টিমধু, আকন্দ আর মাছ আলু। তবে গিলালতা নামের এক লম্বা উদ্ভিদ দর্শনার্থীদের কাছে খুব আকর্ষণীয়। পাটের দড়ির মতো ঝুলে থাকা এই গিলালতা দেখে টারজানের কথা মনে পড়বে দর্শনার্থীদের।
বনে প্রবেশ করতেই কিচিরমিচির শব্দে হরেক রকমের পাখি দর্শনার্থীদের স্বাগত জানাবে। যেন পাখিদের হাট বসেছে এখানে। বনে আছে তিলাঘুঘু, রাজঘুঘু, কাঠঠোকরা, বুলবুলি, হাঁড়িচাঁচা। এই বনে আছে প্রকৃতির ঝাড়ুদারখ্যাত শকুন পরিচর্যা কেন্দ্র। পাখি ছাড়াও দেখা মিলবে খরগোশ, শিয়াল, বেজি, কাঠবিড়ালি। উইয়ের ঢিবির সৌন্দর্য আর বনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া নর্ত নদের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হন দর্শনার্থীরা।
দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার ভোগনগর ইউনিয়নে সিংড়া শালবন। শহর থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-পঞ্চগড় মহাসড়ক থেকে নেমে কিলোমিটারখানেক পথ গেলেই বনের দেখা মিলবে। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ৮৫৯ দশমিক ৯৩ একর জমিতে সিংড়া শালবন। বনের দক্ষিণ প্রান্তে ছোট ছোট মাটির ঘরে ১৩০টি সাঁওতাল পরিবারের বসবাসও রয়েছে এখানে।
শুধু সিংড়া শালবনই নয়, প্রায় একই রকম বৈশিষ্ট্যে দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ধর্মপুর ইউনিয়নে রয়েছে কালিয়াগঞ্জ শালবন। নবাবগঞ্জ উপজেলায় রয়েছে আশুরার বিল ও নবাবগঞ্জ জাতীয় উদ্যান। নবাবগঞ্জ বনের অদূরে রয়েছে সীতাকোট বিহার। স্থানীয় মানুষের গল্প অনুযায়ী, এই বৌদ্ধবিহারকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছিল কিংবদন্তি শিবের কৈলাসবাস আর সীতার বনবাসের গল্প।
ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা দিনাজপুর জেলা প্রাকৃতিকভাবে সৌন্দর্যের আধার বললে অত্যুক্তি হয় না। ঐতিহাসিক ও বিশেষ স্থাপনা বাদেও শহরের পশ্চিম প্রান্তে পুনর্ভবা নদী আর পূর্ব প্রান্তে গাবুড়া নদীর পাড়, মোহনপুর ও গৌড়িপুর এলাকায় রাবার ড্যাম ও নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করে মানুষ। ছুটির দিনে কিংবা সামান্য অবসরে সপরিবার ঘুরে বেড়ানো যায় নবাবগঞ্জ উপজেলায় স্বপ্নপুরী পার্ক, সদর উপজেলায় সিটি পার্ক, বিরল উপজেলায় জীবনমোহন ও চঞ্চল রিসোর্ট, হাকিমপুর উপজেলায় হিলি স্থলবন্দর এলাকায়।