মৌয়ালদের সঙ্গে সুন্দরবনের মধুর ভান্ডারে

মৌমাছির চাকে আগুন দিচ্ছেন দুই মৌয়াল। শনিবার খুলনার কয়রা উপজেলাসংলগ্ন গহিন সুন্দরবনের বস্টুমখালী খাল এলাকায়
ছবি: ইমতিয়াজ উদ্দিন


মাছ ধরার ছোট নৌকায় করে সুন্দরবনের সরু খাল আর বনের গহিনে হেঁটে হেঁটে মৌমাছির চাক খুঁজে বের করে মৌয়ালের দল। সেই চাক থেকে সংগ্রহ করা হয় মধু। প্রতিবছরের ১ এপ্রিল থেকে মধু আহরণে মৌয়ালদের অনুমতি (পাস) দেয় বন বিভাগ। এ কার্যক্রম চলে জুন মাসের শেষ পর্যন্ত। সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল হাজার হাজার মৌয়াল চলতি মৌসুমে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

শনিবার সুযোগ হয় মৌয়ালদের সঙ্গে মধু সংগ্রহে যাওয়ার। খুলনার সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলার বনজীবী আনারুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম ও আবু মুসার সঙ্গী হয়ে সরেজমিনে দেখা হয় সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহের বাস্তব চিত্র। সে এক ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতাই এখানে তুলে ধরা হয়েছে।

নদীর জোয়ার-ভাটার হিসাব কষে রোদের তাপ থেকে বাঁচতে ভোরের আলো ফুটতেই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বনের উদ্দেশ্যে নৌকায় চেপে লোকালয় ছাড়ে মৌয়ালের দল। যাত্রা শুরু হয় কয়রা উপজেলার মঠবাড়ি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শাকবাড়িয়া নদী থেকে। তিন বনজীবীর সঙ্গে গল্পের তালে তালে এগোতে থাকে নৌকা। ঘণ্টাখানেক নৌকা চলার পর সুন্দরবনের বস্টুমখালী খালের পাড়ে নৌকা থামে।

বনের ভেতর অসংখ্য শূলা (শ্বাসমূল) ও বিভিন্ন গাছের কাঁটা থাকে। এসব যেন পায়ে না ফুটে যায়, তাই বনে পা ফেলার আগে বিশেষ প্লাস্টিকের জুতা পরে নেন বনজীবীরা। মৌমাছির চাক কেটে মধু সংগ্রহের জন্য নিতে হয় দা ও বড় ড্রাম বা পাত্র। মৌমাছির হুলের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য চোখ বাদে পুরো মুখমণ্ডল গামছা দিয়ে আবৃত করে নেন মৌয়ালেরা।

গহিন সুন্দরবনের বস্টুমখালী খালের পাড়ে একটি গাছে আগে থেকে মৌচাক দেখে রেখেছিলেন মৌয়াল দলের সদস্যরা। নৌকা থেকে বনে নেমে গাছপালার মধ্য দিয়ে কাদাপানির খানিকটা পথ হেঁটে একটি পশুরগাছের তলায় জড়ো হলেন তাঁরা। সবার চোখ গাছের ডালের দিকে। সেখানে বড়সড় একটি মৌচাক। এবার ওই চাক থেকে মধু সংগ্রহের পালা। প্রথমে চাক থেকে মৌমাছি তাড়াতে ধোঁয়া তৈরির জন্য শুকনা লতাপাতার ‘কাড়ু’ (শুকনা লতাপাতার একটি মোড়ক) তৈরি করতে হবে। ‘হুদো’ নামের একধরনের লম্বাটে পাতাওয়ালা ছোট গাছকে লতা দিয়ে বেঁধে তৈরি করা হবে সেটি। কিন্তু চাকের আশপাশে ওই গাছ না পাওয়ায় এদিক-সেদিক খোঁজাখুঁজি শুরু করেন মৌয়ালেরা।

মৌমাছির চাক থেকে কিছুটা দূরে হুদো গাছের সন্ধান পেয়ে মৌয়াল আনারুল ইসলাম বাকি সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রথমে ‘কু–উ–উ’ বলে একটা ডাক দেন। বাকিরা সেই ‘কু-উ-উ’ ডাকের ফিরতি জবাব দিয়ে যাঁর যাঁর জায়গা থেকে সবাই আনারুলের কাছে চলে আসেন। এরপর মৌয়ালেরা চাকে ধোঁয়া দেওয়ার জন্য দক্ষ হাতে শুরু করেন ‘কাড়ু’ তৈরির কাজ। ভেতরে হুদোগাছের শুকনা পাতা আর ওপরের দিকে কাঁচা পাতা দিয়ে একটি মোড়কের মতো তৈরি করা হয়। এরপর লতাজাতীয় গাছ থেকে লতা কেটে কাঁচা ও শুকনা পাতার মোড়ককে একসঙ্গে বেঁধে তৈরি করা হয় ‘কাড়ু’।

গহিন সুন্দরবনে মৌমাছির চাক কেটে মধু সংগ্রহ করছেন মৌয়ালেরা। শনিবার খুলনার কয়রা উপজেলাসংলগ্ন গহিন সুন্দরবনের বস্টুমখালী খাল এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

কাড়ুর মধ্যে শুকনা আর কাঁচা পাতা একসঙ্গে দিতে হয় বেশি করে ধোঁয়া তৈরির জন্য। এরপর সবার মুখমণ্ডলে গামছা দিয়ে আবারও ভালোভাবে আবৃত করে কাড়ুতে আগুন দিতেই ধোঁয়ায় আচ্ছাদিত হয়ে গেল চারপাশ। কাড়ু নিয়ে সামনে সামনে চললেন মৌয়াল সিরাজুল ও আনারুল। পেছনে মৌয়াল আবু মুসার হাতে একটি নীল রঙের প্লাস্টিকের ড্রাম। তাঁর মধ্যে রয়েছে একটি দা। মৌচাকের কাছাকাছি গিয়ে কাড়ুর জ্বলন্ত মুখ নিচের দিকে ধরার সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়ার মাত্রা বেড়ে পৌঁছে যায় মৌচাকে। ধোঁয়ার আঁচে শোঁ শোঁ শব্দ করে মৌমাছিরা চাক ছেড়ে পালাতে শুরু করলে মধুসমৃদ্ধ চাক দৃশ্যমান হয়। পুরো চাকের তিন ভাগের মাত্র এক ভাগে রয়েছে মধু। মৌয়াল সিরাজুল ইসলাম ফাঁকা হয়ে যাওয়া চাকের মধুর অংশটি দা দিয়ে কেটে ড্রামের মধ্যে রাখেন। পাঁচ-ছয় মিনিটের মধ্যেই মধ্যেই কাজ শেষ। মধুর ড্রাম আর কাড়ু নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটে যাই সবাই। আর মৌমাছিগুলো আবার চাকে ফিরে যেতে শুরু করে।

অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গায় এসে চাক চেপে মধু ও মোম আলাদা করতে করতে মৌয়াল আনারুল ইসলাম বললেন, তাঁর পিঠের দিকে দুটি মৌমাছি হুল ফুটিয়েছে। মৌয়াল আবু মুসা ঝুঁকে পড়ে তার পিঠ থেকে মৌমাছির হুল বের করে ফুলে ওঠা পিঠে একটু মধু লাগিয়ে দিলেন। আনারুল জানালেন, মৌচাকের তিনটি অংশ থাকে। এক অংশে মৌমাছির বাসা অপরাংশে থাকে মধু। আর মধুর নিচে থাকে আরেকটা অংশ, যাকে গুটলি (ফুলের পরাগরেণু) বলে। সেই অংশটা প্রথমে কেটে ফেলে দিয়ে মধুর অংশটা চাকসহ সংগ্রহ করেছেন।

সুন্দরবন হচ্ছে দেশে মধু উৎপাদনের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র। ১৮৬০ সাল থেকে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ হচ্ছে।
শ্যামা প্রসাদ রায়, কর্মকর্তা, কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন

পাশে বসা সিরাজুল ইসলাম বলে উঠলেন, ভুলেও মৌমাছির বাসার অংশ কাটা যাবে না। কাটলে ওই চাকে আর কখনোই মৌমাছি বসার সম্ভাবনা থাকে না। আর যদি বাসাটা রেখে দেওয়া হয়, তাহলে সেই চাকে আবারও মৌমাছি মধু সংগ্রহ করে। ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যেই সেই চাক আবার কাটার উপযোগী হয়।

নৌকায় ফিরে দ্বিতীয় মৌচাকের দিকে চলতে শুরু করেন মৌয়ালেরা। এভাবে তিন–চার ঘণ্টা বনের মধ্যে ঘুরে কয়েকটি চাক কেটে সবাই ফিরে আসেন লোকালয়ে। বাজার থেকে মানুষ মধু কিনে খান। কিন্তু এই মধু সংগ্রহে মৌয়ালদের ঘাম ঝরানো পরিশ্রম আর বনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজের পেছনের গল্প জানা হয় না কারও।

সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা শ্যামা প্রসাদ রায় প্রথম আলোকে বলেন, সুন্দরবন হচ্ছে দেশে মধু উৎপাদনের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র। ১৮৬০ সাল থেকে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ হচ্ছে। সুন্দরবনে নির্বিঘ্নে মধু আহরণের জন্য বন বিভাগের টহল জোরদার করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বন্য প্রাণীর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য মৌয়ালদের চারদিকে খেয়াল রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি মৌচাকের কিছু অংশ রেখে কাটতে বলা হয়েছে। মৌচাকের যে স্থানে ডিম থাকে, সেখান থেকে কিছুটা রেখে বাকি অংশ কাটলে মৌচাকের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। মধুও বেশি হবে।