শেরপুরের সুগন্ধি তুলসীমালা চাল
তুলসীমালা উচ্চ গুণগত মানসম্পন্ন চাল অ্যান্টি–অক্সিজেন, প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজসমৃদ্ধ।
শেরপুর জেলার অন্যতম ঐতিহ্য সুগন্ধি তুলসীমালা চাল। এ চালের পিঠা, পায়েস, খই-মুড়ি, ভাতের সুগন্ধ ও স্বাদ অসাধারণ। ‘পর্যটনের আনন্দে, তুলসীমালার সুগন্ধে’ স্লোগানে তুলসীমালা চালকে জেলার অন্যতম ব্র্যান্ডিং পণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন।
এ চাল আমন মৌসুমে উৎপাদিত হয়। শেরপুর সদর, নালিতাবাড়ী, নকলা, শ্রীবরদী ও ঝিনাইগাতী উপজেলার প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে তুলসীমালা ধান আবাদ হয়। জেলার অর্ধশত স্বয়ংক্রিয় চালকলে তুলসীমালা চাল তৈরি করা হয় এবং প্রতিবছর প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন চাল রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিদেশে রপ্তানি করা হয়। ফলে কৃষিনির্ভর শেরপুরের অর্থনীতিতে তুলসীমালা চাল ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
তুলসীমালা চাল একটি চিকন ও সুগন্ধি প্রজাতির চাল। উচ্চ গুণগত মানসম্পন্ন এ চাল অ্যান্টি–অক্সিজেন, প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজসমৃদ্ধ। ঈদ, পূজা-পার্বণ, বিয়ে, বউ–ভাতসহ বিভিন্ন উৎসব ও অনুষ্ঠানে পোলাও, বিরিয়ানি, মিষ্টান্ন তৈরিতে তুলসীমালা চালের জুড়ি নেই।
জেলা চালকল মালিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মো. শামীম হোসেন বলেন, শেরপুরে উৎপাদিত তুলসীমালা চাল অত্যন্ত উন্নত মানের। এ চাল শেরপুর জেলার ঐতিহ্য। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে সুগন্ধি চালের সবচেয়ে বড় আড়ত শেরপুরে। এ জেলার প্রায় অর্ধশত চালকলমালিক ঢাকার চাহিদার অর্ধেক চাল এ জেলা থেকে সরবরাহ করে থাকেন। এ ছাড়া দেশের কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তুলসীমালা চাল বিদেশে রপ্তানি করা হয়। প্রতিবছর জেলায় প্রায় ১০০ কোটি টাকার তুলসীমালা চাল বেচাকেনা হয়। এ চাল উৎপাদন ও বিপণনের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছেন এবং কৃষিনির্ভর শেরপুরের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, খাদ্যে উদ্বৃত্ত শেরপুর জেলায় রোপা আমন মৌসুমে অর্থাৎ জুলাই-আগস্ট মাসে তুলসীমালা জাতের ধান আবাদ করা হয়। শেরপুর জেলার ৫০ হাজার কৃষক আমন মৌসুমে সাড়ে সাত হাজার হেক্টর জমিতে তুলসীমালা ধান আবাদ করেন। উৎপাদন হয় ১৫ হাজার মেট্রিক টন ধান। এ ধানের বিপরীতে প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টন তুলসীমালা চাল উৎপন্ন হয়। ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে এ চাল বাজারে আসে।
সম্প্রতি শেরপুর শহরের ঢাকলহাটি এলাকার নিউ শ্যামলী অটোমেটিক ড্রায়ার রাইস মিলে দেখা যায়, সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে তুলসীমালা জাতের ধান থেকে চাল উৎপন্ন করা হচ্ছে।
শেরপুর সদর উপজেলার পাকুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ধান-চাল ব্যবসায়ী মো. হায়দার আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি প্রতিবছর তুলসীমালা ধানের আবাদ করি। চলতি মৌসুমে আট একর জমিতে এ ধান আবাদ করেছি। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার ধানের বাম্পার ফলনের আশা করছি। এ ধান আবাদ করে আমি লাভবান হয়েছি।’
জেলা চালকল মালিক সমিতি ও ধান-চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শেরপুর জেলায় উৎপাদিত তুলসীমালা জাতের ধানসহ ময়মনসিংহের দুর্গাপুর, গৌরীপুর, ফুলপুর ও হালুয়াঘাট উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজার থেকে চালকলমালিকেরা সুগন্ধি আতপ ধান কিনে থাকেন। উৎপাদন মৌসুমের শুরুতে কৃষকেরা সাধারণত প্রতি মণ ধান ২০০০ টাকা দামে বিক্রি করেন। ৬৮ কেজি ধানে এক মণ চাল পাওয়া যায়। সে হিসাবে এক মণ চালের উৎপাদন খরচ পড়ে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার টাকা। আর চালকল থেকে প্রতি মণ তুলসীমালা চাল বিক্রি হয় ৩ হাজার ৮০০ টাকায়। তবে গত মৌসুমের শেষ ভাগে এসে দুই-তিন মাস ধরে তুলসীমালা চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ ৪ হাজার ৪০০ টাকা থেকে ৪ হাজার ৫০০ টাকায়। প্রতিবছর প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন তুলসীমালা চাল শেরপুর থেকে দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিদেশে রপ্তানি করা হয়।
শুধু চালকলমালিকেরা নন, অনলাইন বা ই-কমার্সের মাধ্যমেও তরুণ উদ্যোক্তারা দেশের বিভিন্ন জেলায় তুলসীমালা চাল বিক্রি ও সরবরাহ করছেন। তাঁদের একজন হলেন শেরপুর শহরের নবীনগর এলাকার মনজিল মিরা। ২০২০ সালের জুন মাসে করোনাকালে তিনি ‘তুলসীমালা এক্সপ্রেস’ নামের ফেসবুকভিত্তিক একটি গ্রুপ খোলেন। এরপর আড়াই বছর ধরে অনলাইনে অর্ডার নিয়ে ভোক্তাদের কাছে উন্নত মানের তুলসীমালা চাল পৌঁছে দিচ্ছেন।
মনজিল মিরা বলেন, ‘শেরপুরের ব্র্যান্ডিং নির্ধারণ করা হয় পর্যটন খাত এবং একটি ধানের নামে, যে ধানটির নাম তুলসীমালা। জেলা প্রশাসন থেকে তুলসীমালার প্রচার এবং প্রসারের ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়, যেন আমাদের পর্যটন খাত এবং তুলসীমালা চাল দেশবাসীর কাছে পরিচিতি পায়। শেরপুর জেলার সন্তান হিসেবে আমরাও এ উদ্যোগকে এগিয়ে নেওয়ার দায়বদ্ধতা অনুভব করি এবং যথারীতি কাজ শুরু করি।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর শেরপুরের উপপরিচালক সুকল্প দাস বলেন, দেশে-বিদেশে তুলসীমালা চালের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাই এ চাল উৎপাদনে কৃষকদের বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। পাশাপাশি তুলসীমালা চাল উৎপাদনকারীদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে তুলসীমালা চালের মূল্য সংযোজন ও বাজার সংযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে কৃষকেরা যেমন ধানের ন্যায্যমূল্য পাবেন, তেমনি এ চাল বিপণনে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে। ভোক্তারা গুণগত মানসম্পন্ন চাল কিনতে পারবেন।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক সাহেলা আক্তার বলেন, শেরপুরে উৎপাদিত তুলসীমালা চাল ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।