কোরবানির মাংস–রুটি ছিল ছেলের শেষ খাবার, আহাজারি করে বলছিলেন মা
গত মঙ্গলবার ঈদের পরদিন দুপুরের কথা। আয়েশা বেগমকে ডেকে নিজ থেকেই দুপুরের খাবার চেয়েছিল তাহসিন। দশম শ্রেণির ছাত্র তাহসিনের পুরো নাম সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী (১৬)। ভদ্র–নম্র ছেলেটা মায়ের বেড়ে দেওয়া কোরবানির মাংস আর রুটি খেল। এরপর তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল খেলবে বলে। মা একনজর ভালো করে ছেলেটাকে দেখেও নিতে পারলেন না। এই রুটি–মাংসই যে তার শেষ খাবার, তা–ও কি জানতেন তিনি। এখন তাঁর মুখেই যে ওই খাবার উঠবে না।
মঙ্গলবার বাড়ির উঠানে ক্রিকেট খেলার সময় বল ছুটে গিয়ে আটকে যায় পাশের বাড়ির ছাদে। বল নামিয়ে আনতে দোতলা নির্মাণাধীন ভবনের ছাদে ওঠে তাহসিন। এ সময় ভবনের পাশ ঘেঁষে বয়ে যাওয়া ১১ হাজার ভোল্টেজের সংযোগের তারের সঙ্গে আটকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয় সে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। নিহত তাহসিন তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ছিল। স্থানীয় সমিতির হাট উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল সে।
গতকাল বুধবার বিকেল সাড়ে পাঁচটায় তাহসিনের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর দাফন করা হয় পারিবারিক কবরস্থানে। তার আগে বাড়ি থেকে তার লাশের খাটিয়া নেওয়ার সময় মা আয়েশা বেগম ছুটে আসেন। চিৎকার করে জানতে চান ছেলেকে কেন নেওয়া হচ্ছে। জানেন, তবু মায়ের মন। কীভাবেই–বা বিদায় দেবেন বুকের ধনকে।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির সমিতির হাট ইউনিয়নের ছাদেক নগরে তাহসিনদের বাড়ি। গতকাল সেখানে গিয়ে দেখা গেল, আত্মীয়স্বজন আর প্রতিবেশীদের ভিড়। তাহসিনের সহপাঠী-বন্ধুদের অনেকেই এসেছে তাকে শেষবিদায় জানাতে। সবাই চোখ মুছছিল। তাহসিনের আরব আমিরাতপ্রবাসী বাবা নুরুল ইসলাম গতকাল সকালে দেশে এসে পৌঁছান। বাড়িতে এসেই ছেলের নিথর দেহের পাশে বসে পড়েন। সেখান থেকে জানাজার আগপর্যন্ত নড়েননি।
সবকিছু ছাপিয়ে মা আয়েশা বেগমের আহাজারি শোনা যাচ্ছিল। বিলাপের সুরে তিনি বলছিলেন, ‘ছেলে কম্পিউটার শিখছিল। প্রায় বলত, “মা আমি বড় হয়ে কম্পিউটার শিখে চাকরি করব। পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সার হব। আয়রোজগার করব।”’ তার বাবা ২২ বছর ধরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে শ্রমিকের কাজ করেন। তাহসিনকে নিয়ে মা–বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল। তার কিছুই পূরণ হবে না আর। তাহসিনের মা কেবল সে প্রসঙ্গ তুলে বিলাপ করছিলেন।
কোরবানির ঈদের ছুটিতে দেশে আসার কথা ছিল না তাহসিনের বাবা নুরুল ইসলামের। কিন্তু ছেলের মৃত্যুসংবাদ শোনার পর দ্রুত একটা ফ্লাইট ধরে দেশে চলে আসেন। গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে নামেন তিনি। জানাজায় দাঁড়িয়ে সবার কাছে দোয়া চান ছেলের জন্য। এরপর আর কিছুই বলতে পারেননি তিনি। জানাজায় আসা মানুষের চোখেও তখন পানি। সবার মুখে এককথা, পাড়ার এমন মেধাবী, নম্র–ভদ্র ছেলেটি এভাবে অল্প সময়ে পৃথিবী ছাড়বে, কল্পনা করা যায় না। শেষে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে পারিবারিক কবরস্থানে তার দাফন হয়।
তাহসিনকে শেষবিদায় দিতে এসেছিল তার সহপাঠী সাদ সাফওয়ান (১৬) ও আবরার চৌধুরী (১৫)। জানতে চাইলে তারা বলল, ‘একসঙ্গে আমরা দেয়াল টপকে ছাদে উঠছিলাম বল নিতে। কিন্তু আমরা একটু পেছনে আরেকটা দেয়াল থাকায় সামনে এগোনোর সাহস করিনি। তাহসিন আমাদের বলল, “তোরা দাঁড়া, আমি নিয়ে আসি বল।” এরপর চোখের সামনেই সে তারে আটকে থাকল, আমরা কিছুই করতে পারলাম না।’
সমিতির হাট উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সৈয়দ মুহাম্মদ আজগরও এসেছিলেন তাহসিনকে বিদায় দিতে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছাত্রটা যতটা মেধাবী ছিল, তার চেয়েও বেশি ভদ্র ছিল। সে বিজ্ঞানের ছাত্র। আমরা মেনে নিতে পারছি না এমন ঘটনা।’
যে ভবনে তাহসিন বিদ্যুতের তারে জড়ায়, সেই ভবনের মালিক হাসান চৌধুরী সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ভবনের পাশ থেকে বিদ্যুতের উচ্চক্ষমতার তার সরাতে তিনি গত দুই বছর আগে লিখিত আবেদন করেছেন। কিন্তু পল্লীবিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেয়নি। এ কারণে একটা স্কুলছাত্রের প্রাণ গেল।