ভৈরবে র‍্যাবের হেফাজতে মৃত নারীকে ৩১ ঘণ্টা পর দাফন, অপমৃত্যুর মামলা

জানাজার পর লাশ দাফনে বাধা দেন স্বজনেরা। শনিবার বিকেলে নান্দাইলের বরুনাকান্দা গ্রামেছবি: প্রথম আলো

কিশোরগঞ্জের ভৈরবে র‍্যাবের হেফাজতে মারা যাওয়া সুরাইয়া খাতুনকে (৫২) ৩১ ঘণ্টা পর দাফন করা হয়েছে। আজ শনিবার বিকেলে ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার চন্ডিপাশা ইউনিয়নের বরুনাকান্দা গ্রামে ওই নারীকে দাফন করা হয়। এদিকে ওই নারীর মৃত্যুর ঘটনায় ভৈরব থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।

লাশ দাফনের আগে মৃত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা বাধা দেন। সন্তানেরা অভিযোগ করেন, সুস্থ মাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর কারণ না জানা পর্যন্ত তাঁরা লাশ দাফন করতে দেবেন না। পরে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও এক আওয়ামী লীগ নেতার হস্তক্ষেপে লাশ দাফন করা হয়। এ ঘটনায় লাশ দাফনে অন্তত এক ঘণ্টা দেরি হয়।

আরও পড়ুন

গত বৃহস্পতিবার রাতে পুত্রবধূ হত্যা মামলার আসামি হিসেবে নান্দাইলের নতুন বাজার এলাকা থেকে সুরাইয়া খাতুনকে আটক করে র‌্যাব-১৪ ভৈরব ক্যাম্পের সদস্যরা। এরপর গতকাল শুক্রবার সকালে মৃত অবস্থায় তাঁকে ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয় র‍্যাব। মৃত সুরাইয়া নান্দাইলের চন্ডিপাশা ইউনিয়নের বরুনাকান্দা গ্রামের আজিজুল ইসলামের স্ত্রী।

আটক ও হেফাজতে মৃত্যু নিয়ে র‍্যাবের ভৈরব ক্যাম্প কোনো তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। ভৈরব ক্যাম্পের কোম্পানি অধিনায়ক ফাহিম ফয়সাল গতকাল প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ময়মনসিংহ থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসে এ ব্যাপারে কথা বলবেন।

স্বজনদের বাধায় দাফনে বিলম্ব

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোরগঞ্জের সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে আজ বেলা ১১টার দিকে সুরাইয়ার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। সুরাইয়ার ভাসুর সাইফুল ইসলাম লাশ গ্রহণ করেন। বেলা দেড়টার দিকে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স বরুনাকান্দা গ্রামে প্রবেশ করে। লাশ পৌঁছানোর ১৫ মিনিটের মধ্যে জানাজা সম্পন্ন হয়। জানাজা শেষে সুরাইয়ার দুই মেয়ে লিজা ও আফরোজা আক্তার এবং শাশুড়ি আনোয়ার বেগম লাশ দাফনে বাধা দেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, দুই মেয়ে মায়ের লাশ জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। উপস্থিত লোকজনের উদ্দেশে বলতে থাকেন, মৃত্যুর কারণ না জানা পর্যন্ত তাঁরা লাশ দাফন করতে দেবেন না। একপর্যায়ে হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি তৈরি হয়। এমন পরিস্থিতিতে ইউপি চেয়ারম্যান শাহাব উদ্দিন ভূঁইয়া ও আওয়ামী লীগ নেতা আওয়াল মিয়া এগিয়ে আসেন। নান্দাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আবদুল মজিদও ঘটনাস্থলে ছিলেন। এক ঘণ্টা পর লাশ দাফন করা হয়।

সুরাইয়া খাতুন
ছবি: সংগৃহীত

সুরাইয়ার স্বামী পুত্রবধূ হত্যা মামলার ৩ নম্বর আসামি। র‍্যাবের হাতে স্ত্রীর আটক হওয়ার পর থেকে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। অজ্ঞাত স্থান থেকে তিনি আজ একটি ভিডিও বার্তা পাঠান। ভিডিওতে নিজের জীবনের নিরাপত্তা শঙ্কা প্রকাশ করে হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় বিচারের দাবি করেন।

অপমৃত্যুর মামলা

এদিকে সুরাইয়ার মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল রাতে ভৈরব থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করা হয়েছে। ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বুলবুল আহমেদ বাদী হয়ে মামলাটি করেন। এর আগে গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে মৃত্যুর ১২ ঘণ্টা পর কিশোরগঞ্জের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইসরাত জাহানের নেতৃত্বে লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়। সন্ধ্যায় র‍্যাবের ময়মনসিংহ ক্যাম্পের কমান্ডার মো. মহিবুল ইসলাম খান ঘটনাস্থলে আসেন।

পুলিশ ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, মৃত সুরাইয়ার ছেলে তাইজুল ইসলামের (২৩) সঙ্গে একই উপজেলার ভেলামারী গ্রামের হাসিম উদ্দিনের মেয়ে রেখা আক্তারের (২০) বিয়ে হয়। গত ২৬ এপ্রিল শ্বশুরবাড়িতে রেখা মারা যায়। এ ঘটনায় রেখার শ্বশুর আজিজুল ইসলাম থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করেন। অন্যদিকে রেখার মা রামিছা বাদী হয়ে স্বামী তাইজুল ইসলাম, শ্বশুর আজিজুল ইসলাম ও শাশুড়ি সুরাইয়া খাতুনকে অভিযুক্ত করে আদালতে একটি মামলা করেন। মামলাটি বুধবার নান্দাইল থানায় নথিভুক্ত হয়।

র‍্যাব সূত্র জানায়, হত্যা মামলার পর সুরাইয়ার ছেলে তাইজুলকে বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা থেকে আটক করে র‍্যাব। স্বজন ও পুলিশ সূত্র জানায়, ওই রাতে নান্দাইলের নতুন বাজার এলাকা থেকে সুরাইয়াকে আটক করেন র‍্যাবের ভৈরব ক্যাম্পের সদস্যরা। তখন আজিজুল সেখান থেকে পালিয়ে যান। আজিজুল ও সুরাইয়া পুলিশের ফোন পেয়ে থানায় যাচ্ছিলেন। পথে সুরাইয়া আটক হন। পরদিন সকালে মৃত অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে নেয় র‍্যাব। ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বিষয়টি গতকাল প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছিলেন।

পুলিশ জানায়, মূলত পুত্রবধূ হত্যা মামলার আসামি হিসেবে সুরাইয়াকে আটক করে র‍্যাব। সুরাইয়ার মৃত্যুর পর র‍্যাবের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকর্মীদের কোনো তথ্য দেওয়া হচ্ছে না।

নান্দাইল মডেল থানার উপপরিদর্শক নাজমুল হাসান থানায় ডাকার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘ডাকা হয়েছিল সত্য। কিন্তু তাঁরা থানায় আসার আগে নতুন বাজার এলাকায় র‍্যাবের হাতে আটক হয়।’

ওসি মোহাম্মদ আবদুল মজিদ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল র‍্যাবের সদস্যরা আসামি মো. তাইজুল ইসলামকে নান্দাইল থানায় হস্তান্তর করে। রাতেই তাঁকে আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করেও ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার মাছুম আহমেদ ভূঁইয়া ও গৌরীপুর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সুমন মিয়ার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।