‘দুইটা বছর হয়ে গেল, বাবার খোঁজ পেলাম না’
নিখোঁজ সরেন্দ্র নাথ বর্মণের বাড়ি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার সাকোয়া ইউনিয়নের নগর সাকোয়া-ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে।
‘নৌকাডুবির ঘটনা ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে নৌকার পেছন দিকে ধপধপে সাদা পাঞ্জাবি পরা যে লোকটা দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনিই আমার বাবা। ওই দিন বাবাসহ আমাদের সাতজন স্বজন নিখোঁজ হন। পরে আমার দুই বোনসহ পাঁচজনের লাশ পেয়েছি, কিন্তু বাবাকে পাইনি। বাবার লাশটা পেলে অন্তত নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম যে আমরা বাবার সৎকারের কাজটা নিজেরা করতে পেরেছি। আজ দুইটা বছর হয়ে গেল, বাবার খোঁজ পেলাম না। আর মনে হয় পাওয়া যাবে না। এ জন্য বাবাকে ফিরে পাবার আশা অনেকটা ছেড়েই দিয়েছি।’
কথাগুলো বলছিলেন দুই বছর আগে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় নৌকাডুবিতে নিখোঁজ সরেন্দ্র নাথ বর্মণের (৬৩) বড় ছেলে স্বপন চন্দ্র বর্মণ (৩৯)। এ সময় তাঁর দুই চোখে পানি ছলছল করছিল। পাশে বসে নির্বাক হয়ে কথাগুলো শুনছিলেন স্বপনের মা শান্তি রানী (৬০)। নৌকাডুবির দুই বছর পরও খোঁজ না পাওয়া সরেন্দ্র নাথ বর্মণের বাড়ির বাইরের উঠানে বসে গত সোমবার বিকেলে কথা হয় তাঁর স্ত্রী ও বড় ছেলের সঙ্গে। তাঁদের বাড়ি বোদা উপজেলার সাকোয়া ইউনিয়নের নগর সাকোয়া-ডাঙ্গাপাড়া এলাকায়।
মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ২০২২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর দুই মেয়ে, এক মেয়ের জামাই, বেয়াইসহ ছয়জন স্বজনের সঙ্গে নদী পার হচ্ছিলেন সরেন্দ্র নাথ বর্মণ (৬৩)। নৌকায় গাদাগাদি করে মানুষ উঠায় সাতজনই ছিলেন খুব কাছাকাছি। মাঝ নদীতে নৌকাডুবিতে তলিয়ে যান তাঁরা। এ সময় বিনয় চন্দ্র বর্মণ (৪২) নামের তাঁদের এক স্বজন সাঁতরে পাড়ে উঠতে পারলেও হারিয়ে যান অন্য ছয়জন। এরপর উদ্ধার অভিযানে সরেন্দ্র নাথের বেয়াই, দুই মেয়ে, এক মেয়ের জামাইসহ পাঁচজনের লাশ উদ্ধার হলেও এখনো নিখোঁজ সরেন্দ্র নাথ বর্মণ। বাবাকে জীবিত অথবা মৃত খোঁজে পেতে এখনো মাঝেমধ্যে নদীর পাড়ে যান তাঁরা। এমনকি নদীর ধারে গিয়ে একাধিকবার করেছেন গঙ্গাপূজা।
খুপে আশা কইছিনো যে মানুষটাক পাওয়া যাবে। আজি দুইডা বছর হয়া গেল বাপু মানুষটার শরীরের একটা টুকরা কাপড়েরও সন্ধান পানোনি।
ঘটনার দিন দুপুরে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বাজারের পাশে করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাট থেকে শতাধিক মানুষ নিয়ে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকা বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরের দিকে যাচ্ছিল। যাত্রীদের অধিকাংশই বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। ঘাট থেকে কিছুদূর যাওয়ার পর নৌকাটি ডুবে যায়। ঘটনার চতুর্থ দিন পর্যন্ত নৌকাডুবির ঘটনায় ৬৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল।
এরপর জেলা প্রশাসনের করা নিখোঁজের তালিকায় ছিলেন এক শিশুসহ তিনজন। ঘটনার দেড় মাসের মাথায় নৌকাডুবির স্থান থেকে প্রায় ৫০ গজ দক্ষিণে নদীর বালুর নিচ থেকে ভূপেন্দ্র নাথ বর্মণের (৪২) অর্ধ্বগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘটনার ৪৭ দিনের মাথায় কাছাকাছি স্থানে বালুর নিচ থেকে জয়া রানী (৪) নামের একটি শিশুর গলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এখন নিখোঁজের তালিকায় রয়েছেন শুধুই সরেন্দ্র নাথ বর্মণ।
সরেন্দ্র নাথ বর্মণের স্ত্রী শান্তি রানী বলেন, ‘খুপে (খুব) আশা কইছিনো (করেছি) যে মানুষটাক পাওয়া যাবে। আজি দুইডা বছর হয়া গেল বাপু মানুষটার শরীরের একটা টুকরা কাপড়েরও সন্ধান পানোনি। চোখের সামনোত দুইডা বেটির (মেয়ের) লাশের সৎকার হইল, কিন্তু ওর বাপের মুখখান আর দেখা পানুনি।’
ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, ঘটনার দিন ৪৭ ফুট দীর্ঘ ও সাড়ে ১০ ফুট প্রস্থ (মাঝের অংশ) নৌকাটিতে মোট ১০৫ জন যাত্রী উঠেছিলেন। নৌকাডুবির পর সাঁতরে পাড়ে ওঠেন ৬ জন, জীবিত উদ্ধার হন ২৭ জন। এরপর লাশ উদ্ধার হয়েছে ৭১ জনের এবং নিখোঁজ রয়েছেন ১ জন।
সোমবার দুপুরে করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাটের নৌকাডুবির স্থান ঘুরে দেখা যায়, বেশ কিছুদিন ধরে বৃষ্টি না হওয়ায় ঘটনার দিনের তুলনায় করতোয়া নদীর পানি অনেকটাই কম। নদীর ওপর চলছে দুটি (ওয়াই আকৃতির) সেতু নির্মাণের কাজ। তবে নৌকা দিয়ে নদী পারাপার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
এ বিষয়ে পঞ্চগড় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, ঘটনাস্থলে ও এর আশপাশের বিভিন্ন এলাকার লোকজন এবং নদীর বালু শ্রমিকদের বিষয়টি জানিয়ে রাখা হয়েছে। কোনো লাশ বা সংশ্লিস্ট কিছু পাওয়া গেলে স্থানীয় ফায়ার সার্ভিস ও থানা পুলিশকে খবর দেওয়ার জন্য স্থানীয়দের অনুরোধ করা হয়েছে।
এলজিইডি সূত্রে জানা যায়, আউলিয়ার ঘাটে গত বছরের নভেম্বরে মোট ৮৯১ মিটার দৈর্ঘ্যের ২টি সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়। মাড়েয়া ডাঙ্গাপাড়া এলাকায় সেতু দুটির সংযোগ সড়কে ওয়াই আকৃতি যুক্ত হবে।
দুটি সেতুর মধ্যে একটি মাড়েয়া-ডাঙ্গাপাড়া থেকে নদীর ওপারে চপড়ামারী এলাকা এবং অপরটি মাড়েয়া-ডাঙ্গাপাড়া থেকে নদীর ওপারে নিশানডোবা-বদেশ্বরীর সঙ্গে যুক্ত হবে।