কৃষকের ভরসা ‘কেঁচো মানিক’

৪০ শতক জমিতে গড়ে তোলা খামারটিতে প্রতি মাসে উৎপাদিত হয় প্রায় ৫০ টন কেঁচোসার।

সবুজ অ্যাগ্রো ফার্মে কেঁচো সার প্রক্রিয়াকরণের কাজে শ্রমিকদের সঙ্গে ব্যস্ত সময় পার করছেন মানিক বর্মা। সম্প্রতি দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার আরাজী শিয়ালখেদা গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

বসতবাড়ি-সংলগ্ন ৪০ শতক জমিতে বড় টিনের ছাউনি। ছাউনির নিচে কেঁচোসার (ভার্মি কম্পোস্ট) প্রস্তুত করা হচ্ছে। মেঝেতে ৫ থেকে ৭ ইঞ্চি পুরু করে বিছানো গোবর। ছয় শ্রমিক গোবর উল্টেপাল্টে শুকানোর কাজ করছেন। পাশেই শুকনা গোবর ঝুরঝুরে করা হচ্ছে। সেই গোবর বস্তায় ভরে ওজন দেওয়া হচ্ছে। চেয়ারে বসে আছেন মানিক বর্মা (৩৭)। খাতা দেখে চাহিদা অনুযায়ী কৃষককে সরবরাহ করছেন কেঁচোসার।

১৫ বছর ধরে এ সার তৈরি করে সরবরাহ করছেন মানিক বর্মা। এর গুণাগুণে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন কৃষকেরাও। জমি প্রস্তুত করে ছুটে আসছেন মানিকের খামারে। ১০ কেজি থেকে ১ টন পর্যন্ত সার কিনছেন। সম্প্রতি রাসায়নিক সারের ঊর্ধ্বমুখী বাজারে কেঁচোসার সরবরাহ করে কৃষকের ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেছেন তিনি।

মানিক বর্মার বাড়ি দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার শিয়ালখেদা গ্রামে। ছোটবেলা থেকে বাবার সঙ্গে কৃষিকাজে যুক্ত ছিলেন। ২০০৪ সালে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কেঁচোসার তৈরির প্রশিক্ষণ নেন। পরে বাসায় কয়েকটি টবে কেঁচো আর গোবরের মিশ্রণে সার তৈরি শুরু করেন। এরপর টব থেকে চাড়ি, চাড়ি থেকে রিং—সর্বশেষ বাড়িসংলগ্ন ৪০ শতক জমিতে গড়ে তুলেছেন ‘সবুজ স্বপ্ন অ্যাগ্রো ফার্ম’। সাত থেকে আটজন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করেন খামারে। প্রতি মাসে উৎপাদিত হয় প্রায় ৫০ টন কেঁচোসার। প্রতি কেজি সার বিক্রি করা হয় ১২ থেকে ১৫ টাকা দরে।

মানিক বর্মা বলেন, প্রতি টন সার প্রস্তুত করতে ১০ কেজি কেঁচো দরকার। ৩০ দিন পর এর থেকে পাওয়া যায় ৭৫০ কেজি সার। সাধারণত কেঁচোর আয়ুষ্কাল ৯৫ দিন। এ সময়ে দুবার গড়ে চারটি করে ডিম দেয়। ফলদ গাছ বা উঁচু জমির ফসলে পরপর তিনবার এ সার ব্যবহার করলে ডিম থেকে উৎপন্ন কেঁচো ওই স্থানে নিজে থেকেই সার উৎপাদন করতে থাকে। ফলে পরবর্তী দু-তিনটি ফসলে সার ব্যবহার না করলেও চলে।

জমিতে কেঁচোসার ব্যবহারে বিঘাপ্রতি অন্তত ৩০০ টাকা সাশ্রয় হয় বলে জানিয়েছেন বীরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু রেজা মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, এক বিঘা জমিতে তিন টন কেঁচোসার দিলে রাসায়নিক সারের খরচ কমবে পাঁচ কেজি। এ সারে গাছের অত্যাবশ্যকীয় ১৬টি খাদ্য উপাদানের ১০টিই বিদ্যমান।

কৃষি বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও কৃষক—সবাই জানেন মানিকের খামারের খবর। এ ক্ষেত্রে তাঁর নামের সামনে যুক্ত হয়ে গেছে ‘কেঁচো’ শব্দটি। মানিক বর্মা হয়ে উঠেছেন ‘কেঁচো মানিক’।

এ নাম শুনলে আনন্দ পান জানিয়ে মানিক বলেন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় কেঁচোসার প্রস্তুতকারী প্রায় সবাই চেনেন তাঁকে। এএলআরডি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষক হয়ে ৪০টিরও বেশি জেলায় কেঁচোসারের গুণাবলি ও প্রস্তুতপ্রণালি বিষয়ে দুই সহস্রাধিক উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। মানিকের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে এটিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন কেউ কেউ। সার বিক্রির আয়ে সম্প্রতি পাকা বাড়ি ও গরুর খামারের শেড নির্মাণ শুরু করেছেন মানিক বর্মা।

মানিকের খামারে কেঁচোসার কিনতে আসা কয়েক কৃষক জানিয়েছেন, এ সার ব্যবহারের ফলে জমিতে রাসায়নিক সার কম ব্যবহার করতে হচ্ছে। মানিকের কাছে নিয়মিত সার কেনেন মুসলিম পাটোয়ারি। তিনি বলেন, এবার ৪০ বিঘা জমিতে স্ট্রবেরি চাষ করছেন। ইতিমধ্যে ৩৫ টন কেঁচোসার কিনেছেন মানিকের কাছ থেকে। এ সার ব্যবহারে ফসলের রোগবালাই ও পোকামাকড় কম হয়।

জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দিনাজপুরে দুই শতাধিক উদ্যোক্তা কেঁচো চাষের যুক্ত রয়েছেন। গত অর্থবছরে জেলায় কেঁচোসারের উৎপাদন ছিল ২ হাজার ১৬৫ মেট্রিক টন।

হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রপ ফিজিওলজি বিভাগের অধ্যাপক মুক্তাদুল বারী বলেন, জমিতে দীর্ঘদিন ধরে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করায় মাটির ছোট ছোট অণুজীব মারা যায়; সেখানে কেঁচোসার অণুজীবগুলো সক্রিয় রাখে। ফলন বাড়াতে রাসায়নিক সারের প্রয়োজন আছে। তবে পাশাপাশি কেঁচোসারও প্রয়োজন।