এক কেজি ওজনের ইলিশ বেচে জেলে পান ১৩৫০ টাকা, ভোক্তা কেনেন ২০২৫ টাকায়

সাগর ও নদীতে ইলিশ আহরণ বাড়লেও বাজারে দাম আকাশছোঁয়া। বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণকেন্দ্র থেকে মাছ পাঠানো হচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। গত সোমবার সকালেছবি: প্রথম আলো

বেসরকারি ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা প্রদীপ বিশ্বাস। গত শনিবার বরিশাল নগরের বাংলাবাজারে এসেছিলেন ইলিশ কিনতে। ৫০০ গ্রামের বেশি ওজনের ইলিশ দেখে দাম জানতে চাইলেন। বিক্রেতা প্রতি কেজি ইলিশের দাম হাঁকলেন ১ হাজার ৬০০ টাকা। দাম শুনে তাঁর চোখ কপালে ওঠার দশা। কিছু না বলে তিনি অন্য দোকানের দিকে উঁকি দেন। এরপর নীরবে হেঁটে গেলেন। পেছন থেকে মাছ বিক্রেতা তাঁকে ডেকে বলছিলেন, ‘কী, দাম কইবেন না!’

প্রদীপ বিশ্বাস আক্ষেপ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাচ্চারা ইলিশ খেতে বায়না ধরেছে। কিন্তু দাম শুনে আর সাহস হলো না। মৌসুমেও যদি ইলিশের এত দাম হয়, তাহলে মানুষ কিনবে কীভাবে! আর কেনই-বা এখনো এত দাম?’

ভরা মৌসুমে ইলিশের দাম নিয়ে প্রদীপ বিশ্বাসের মতোই দক্ষিণাঞ্চলের সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। পাঁচ-সাত বছর আগেও এ অঞ্চলে এই মৌসুমে এক কেজির নিচের ইলিশ খুচরা বাজারে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হতো। এক কেজির ওপরেরগুলো ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়।

সাধারণ ক্রেতাদের প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, নদী-সাগর থেকে আহরিত ইলিশ খুচরা বাজারে ক্রেতাদের কাছে আসতে চার দফা হাতবদল হয়। যার প্রতিটি ধাপে বাড়ে ইলিশের দাম। এই ধাপগুলোকে ‘চোরা ফাঁদ’ উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বরগুনার পাথরঘাটায় একজন জেলে একটি এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি করে ১ হাজার ৩৫০ টাকা পান। ক্রেতাদের সেই ইলিশ কিনতে হয় ২ হাজার ২৫ টাকায়। এই অতিরিক্ত ৬৭৫ টাকা যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে।

জেলে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরিস্থিতি অনুযায়ী পাইকারি বাজারে ইলিশের দাম নির্ধারণ করে দেয় এই আড়তদারেরা। কারণ, আড়তদারেরা জেলেদের মধ্যে দাদন দেয়। মাছের আহরণ ও দাম যত বাড়বে, তত বেশি তাঁরা কমিশন (সুদ) পাবেন। ফলে আড়তদারদের ফাঁদেই ইলিশের দামে বড় কারসাজি হচ্ছে। এ ছাড়া জ্বালানির দাম দ্বিগুণ হওয়া ছাড়াও বরফ, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ইলিশ আহরণে এখন ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। এর প্রভাব পড়ছে বাজার ব্যবস্থায়।

চার ধাপে ইলিশ পৌঁছায় ক্রেতার হাতে

সাগর ও নদী থেকে আহরণ করা ইলিশ আসে পাইকারি বাজার ঘাটে। সেখানে যে ট্রলারের জেলে যে আড়ত থেকে দাদন নিয়েছেন, সেই আড়তেই মাছ বিক্রির জন্য দিতে হয়। এর বিনিময়ে আড়তদার বিক্রীত মাছ থেকে কমিশন পান। আড়তদাররা মৌসুমে জেলেপ্রতি দেড় থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত দাদন দেন। এ জন্য আড়তদারদের শর্ত হচ্ছে দাদনের অর্থ আসল হিসেবে থাকবে এবং আহরিত মাছ বিক্রি করে মুনাফা হিসেবে কেটে রাখবেন। এটাকে তাঁরা কমিশন নাম দিয়েছেন।

আড়তদারদের এসব মাছ বিক্রি করেন পাইকাররা। এতে পাইকাররাও একটি নির্ধারিত কমিশন পান। এই মাছ কিনে দেশের বিভিন্ন স্থানের বড় মোকামে নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা। সেখানে নিয়ে তাঁরা আরেক দফা লাভে বিক্রি করেন খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা আরেক দফা মুনাফার পর তা সরাসরি ক্রেতার হাতে যায়।
পাথরঘাটা বিএফডিসি মৎস্য আড়তদার মালিক সমিতির সহসভাপতি আলম মোল্লা বলেন, চারটি ধাপের প্রতিটিতেই ব্যবসা জড়িত। আবার অনেক প্রভাবশালীর স্বার্থও এখানে জড়িয়ে থাকে। তাই এককভাবে কেউ চাইলেই এটা কমাতে পারেন না। তা ছাড়া ইলিশ রাজকীয় মাছ, তাই সব সময়ই এর বাজার ঊর্ধ্বমুখী রাখেন বড় ব্যবসায়ীরা।

আড়তে চলছে ইলিশ বেচাকেনা। গত সোমবার বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণকেন্দ্র
ছবি: প্রথম আলো

দাম কতটা বাড়ে, কীভাবে বাড়ে?

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৎস্যবন্দর বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণকেন্দ্র। বিএফডিসি (বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন) পরিচালিত এই মৎস্যবন্দরের জেলে, আড়তদার ও পাইকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেলেরা যখন মাছ ধরে ট্রলার নিয়ে বন্দরে আসেন, তখন তাঁরা নির্ধারিত আড়তে এসব মাছ বিক্রির জন্য দেন। এরপর আড়তদারেরা এই মাছ স্থানীয় পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন।

বুধবার (২১ আগস্ট) পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণকেন্দ্রে ১ কেজি ওজনের এক মণ ইলিশ বিক্রি হয়েছে গড়ে ৬০ হাজার টাকায়। আড়তদার পাইকারদের কাছে ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি করলেও জেলেরা আড়তদারদের কাছ থেকে মূল্য পান ৫৪ হাজার টাকা। বাকি ৬ হাজার টাকা আড়তদারেরা কমিশন বাবদ রেখে দেন। অর্থাৎ জেলে প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি করে পান ১ হাজার ৩৫০ টাকা।

এরপর ওই মাছ স্থানীয় পাইকাররা ঢাকার আড়তদারদের কাছে বিক্রির সময় তিন–চার হাজার টাকা লাভ করেন। আবার ঢাকার আড়তদার ওই মাছ খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করে চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা লাভে করেন। এই মাছ যখন খুচরা বিক্রেতারা বাজারে বিক্রি করেন, তখন মণপ্রতি ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা লাভ করেন। এতে এক কেজি আকারের এক মণ ইলিশ জেলের কাছ থেকে ঢাকা কিংবা অন্যান্য জেলার খুচরা বাজারে ক্রেতাদের হাতে পৌঁছাতে দাম দাঁড়ায় ৮১ হাজার টাকায়। অর্থাৎ ভোক্তাকে এক কেজি ইলিশ কিনতে গুনতে হয় গড়ে ২ হাজার ২৫ টাকা। গত কয়েক দিন বরিশালের মাছের বাজারে খোঁজ নিয়ে এক কেজি আকারের প্রতিটি ইলিশ ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। এভাবে চার ধাপে এক মণ ইলিশ থেকে ২৭ হাজার টাকা যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইলিশ মাছের ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গত এক দশকে দেশের পাইকারি থেকে খুচরা মোকাম পর্যন্ত একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা এই সিন্ডিকেট ভেঙে ফেলা খুব দুরূহ। সরকার বদল হলেও নতুন যাঁরা আসেন, তাঁরা এসব সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ নেন।

আসলেই কি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব?

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক অপূর্ব অধিকারী বলেন, ‘আমাদের একার পক্ষে এটা করা অসম্ভব। এ জন্য প্রশাসনসহ সবার সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার। আমাদের জনবল সীমিত। তারপরও আমরা বড় মোকাম যেসব স্থানে রয়েছে, সেখানের প্রশাসন, সচেতন নাগরিক, মৎস্য বিভাগের সঙ্গে সচেতনতা সভা করার উদ্যোগ নিতে চেষ্টা করব।’

পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণকেন্দ্রের সহকারী বিপণন কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার সরকার মনে করেন, প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সম্মিলিত কঠোর নজরদারি থাকলে এসব ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব। এতে অনেকাংশে ইলিশের দাম সহনীয় হতে পারে।

যথাযথ আইন প্রয়োগ করতে পারলে এসব সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া সম্ভব বলে মনে করেন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বরিশাল জেলার সাধারণ সম্পাদক রণজিৎ দত্ত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এটা খুবই ভয়ংকর এক ফাঁদ। সাদাচোখে দেখা যায় না। তবে এই ফাঁদগুলো তৈরির পেছনে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের অবদান শতভাগ। এটা ভাঙা যে অসম্ভব, তা নয়। তবে এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পাশাপাশি প্রশাসন, মৎস্য বিভাগ, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং সচেতন নাগরিকদের সম্মিলিতভাবে আন্তরিক উদ্যোগ নিতে হবে।