ছাত্রলীগের নির্যাতনের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন মুকুল, পাননি বিচার

নির্যাতনের শিকার বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুকুল আহমেদ (মাঝে)ফাইল ছবি

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুকুল আহমেদ এখনো নির্যাতনের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা চললেও পুরোপুরি সুস্থ হননি তিনি। বাঁ হাতে সংক্রমণ থাকায় এখনো ব্যথা হয়, স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন না। ছাত্রলীগের নামধারী যেসব সন্ত্রাসী তাঁর ওপর নির্যাতন চালান, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তদন্ত কমিটি করে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও আজও তা আলোর মুখ দেখেনি।

আক্ষেপ করে মুকুল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত বড় নৃশংসতা হলো আমার ওপরে, না পেলাম বিচার, না পেলাম সুস্থ জীবন। আমার বাবা গরিব দিনমজুর, চিকিৎসা করাতে গিয়ে এখন ক্লান্ত ও নিঃস্ব।’

গত বছরের ১২ অক্টোবর রাতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের একটি কক্ষে নিয়ে ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মুকুলকে রাতভর নির্যাতন করেন ছাত্রলীগের নামধারী কয়েকজন সন্ত্রাসী। পিটিয়ে তাঁর বাঁ হাত ভেঙে দেন। পরদিন সকালে সহপাঠীরা তাঁকে উদ্ধার করে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখান থেকে তাঁকে ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে পাঠানো হয়।

মুকুল বঙ্গবন্ধু হলের ৫০২০ নম্বর কক্ষের আবাসিক ছাত্র। ঘটনার দিন ইংরেজি বিভাগের অষ্টম ব্যাচের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী তানজিদ মঞ্জু ও সিহাব উদ্দিন নির্যাতন চালান বলে অভিযোগ। তাঁরা মুকুলকে ৪০১৮ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে মারধর করেন। পরে হামলার দায় এড়াতে তাঁকে ‘শিবির নেতা’ দাবি করে ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করেন। পুরো ঘটনাকে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অভিহিত করে উল্টো মুকুলের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দাবি তুলেছিলেন।

আজ বৃহস্পতিবার মুকুল বলেন, ‘আমি কোনো দিন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হইনি। আমাকে শিবির ট্যাগ দিয়েছে। সরকার পতনের পর থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা তাঁকে এ নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে শাসাচ্ছেন। অন্যথায় ব্যক্তিগতভাবে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছে।’ তিনি বলেন, মা–বাবা এখনো তাঁর জীবন নিয়ে শঙ্কিত। যদি ওরা আরও কিছু করেন। সেই রাতের নির্যাতনের কথা মনে পড়লে আজও শিউরে ওঠেন। হাতের ব্যথায় রাতে ঘুমাতে পারেন না। উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিকে শরীর নিস্তেজ লাগে।

সেই রাতের বর্ণনা দিয়ে মুকুল জানান, সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যায় টিউশনি করে হলে ফিরছিলেন। পথে রূপাতলী বাসস্ট্যান্ডে বিভাগের প্রথম বর্ষের কয়েকজন ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়। মুকুল তাঁদের কাছে রাতে ক্যাম্পাসে যাওয়ার কারণ জানতে চান। ওই শিক্ষার্থীরা জানান, দশম ব্যাচের (দ্বিতীয় বর্ষ) বড় ভাইয়েরা বঙ্গবন্ধু হলে ডেকেছেন। পরে মুকুল হলে ফিরে দশম ব্যাচের মেসেঞ্জার গ্রুপে একটি বার্তা দেন, ‘আমাদের ব্যাচের নামে ছোট ভাইদের ডাকা হয়েছে, অথচ আমরা জানি না। আগেও এভাবে ডেকে র‍্যাগিং করা হয়েছে। তখন বিভাগের শিক্ষকদের কাছে আমাদের কৈফিয়ত দিতে হয়েছে। এটা বাড়াবাড়ি ছাড়া কিছুই নয়।’ এই বার্তা দেওয়ার এক মিনিট যেতে না যেতেই তানজিদ মঞ্জু তাঁকে ফোন করে শেরেবাংলা হলের দিকে যেতে বলেন। এশার নামাজ শেষে যাওয়ার কথা বললে তখনই তাঁকে যেতে বলা হয়।

মুকুল বলেন, রাত আটটার দিকে বঙ্গবন্ধু হলের পাঁচতলার নিজের কক্ষ থেকে চতুর্থ তলায় নামতেই তানজিদের সঙ্গে দেখা হয়। তখন তাঁকে ধরে চতুর্থ তলার ৪০১৮ নম্বর কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই নিয়ে কক্ষের সবাইকে বের করে দিয়ে কক্ষটি আটকে দেন তানজিদ। কেন মেসেঞ্জার গ্রুপে ওই বার্তা দিয়েছেন, কৈফিয়ত চান। এ সময় তানজিদ বলেন, ‘তোর জন্য আমি একাদশ ব্যাচটাকে গোছাতে পারছি না।’ এসব বলেই নির্যাতন শুরু করেন। মঞ্জু ও তাঁর সহযোগী সিহাব তাঁকে উপর্যুপরি কিলঘুষি, লাথি এবং একপর্যায়ে জিআই পাইপ ও চেয়ারের ভাঙা কাঠের হাতল দিয়ে পিটিয়ে হাত ভেঙে দেন। একপর্যায়ে জ্ঞান হারালে দিবাগত রাত তিনটার দিকে কক্ষে ফেলে রেখে বাইরে থেকে তালা দিয়ে চলে যান। পরদিন সকাল ১০টার দিকে অ্যাম্বুলেন্সে তাঁকে হাসপাতালে আনা হয়।

এর আগে ওই বছরের ৫ আগস্ট মধ্যরাতে মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ গ্রুপের কর্মী আয়াত উল্লাহকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে গুরুতর জখম এবং পায়ের রগ কেটে পঙ্গু করে দেওয়ার অভিযোগ আছে মঞ্জু ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে। গভীর রাতে হেলমেট পরা ছাত্রলীগের একটি পক্ষ ওই হামলা করেছিল।

মুকুলের বাড়ি নরসিংদী সদরে। বাবা সাফিজ উদ্দীন (৬৫) কাঠমিস্ত্রির সহকারীর কাজ করে সংসার চালান। মা জুলেখা বেগম (৫৮) গৃহিণী। ছয় বোন, দুই ভাইয়ের বড় সংসার চলে টানাপোড়েনে। পাঁচ বোনের বিয়ে হয়ে গেলেও ছোট বোন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। মুকুল টিউশনি করে নিজের ও বোনের পড়াশোনার ব্যয় নির্বাহ করতেন। কিন্তু নির্যাতনে গুরুতর আহত হওয়ার পর টিউশনি করতে পারেন না। অন্যদিকে চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে গিয়ে দায়দেনা করতে হয়েছে বাবার।

আরও পড়ুন

মুকুল বলেন, ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ১০ হাজার টাকা চিকিৎসা সহায়তা দিয়েছিল। এরপর আর খোঁজও নেয়নি। তদন্ত কমিটি করা হলেও এখনো তা আলোর মুখ দেখেনি, বিচার তো দূরের কথা। ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিরা স্নাতকোত্তর শেষ পর্বের পরীক্ষা দিচ্ছেন। মাসখানেক বা তারও কম সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে যাবে। এরপর আর কী বিচার করবে প্রশাসন?

জানতে চাইলে প্রক্টর আব্দুল কাইয়ুম প্রথম আলোকে বলেন, সাবেক উপাচার্যের সময় এসব ঘটনা ঘটেছে। নতুন উপাচার্য দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনিও কয়েক দিন আগে প্রক্টরের দায়িত্ব পেয়েছেন। গতকাল বুধবার তাঁরা তদন্ত কমিটির সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা বলেছেন, নির্ধারিত সময়েই তাঁরা প্রতিবেদন দিয়েছেন। কিন্তু আগের প্রশাসন কেন প্রকাশ ও বিচার করেনি জানেন না। তাঁরা এটা নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। অল্প দিনের মধ্যেই শৃঙ্খলা কমিটির সভা ডেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন