হাওরে বাঁধা সারি সারি নৌকা, মিলছে না পর্যটক

কিশোরগঞ্জের নিকলী সদরের বেড়িবাঁধ এলাকায় ঘাটে সারি সারি বাঁধা নৌকা। মিলছে না পর্যটকের দেখা। বিপাকে নৌকার মালিকরা। শনিবারের ছবিপ্রথম আলো

সপ্তাহখানেক আগেও কিশোরগঞ্জের নিকলী হাওরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পর্যটকের ঢল ছিল। ভ্রমণপিপাসুদের পদচারণে মুখর থাকত রাস্তাঘাট। হোটেল-রেস্তোরাঁয় থাকত মানুষের ভিড়। সেখানে এখন শুধু নীরবতা আর নিস্তব্ধতা। লাগাতার কারফিউ আর কোটা সংস্কার আন্দোলনে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে হাওরের চিরচেনা দৃশ্যপটে এ অবস্থা দাঁড়িয়েছে।

দিগন্তবিস্তৃত হাওরে বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে বেড়ে ছিল স্পিডবোট আর নৌকার কদর। যদিও নৌকা আর স্পিডবোটের অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে অনেকটা অসন্তোষ ছিল ভ্রমণপিপাসুদের মধ্যে। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে সহিংসতায় বর্ষার ভরা মৌসুমেও পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে হাওর এলাকা। এমনকি ছুটির দিন শুক্র ও শনিবারও হাওরে থাকছে সুনসান নীরবতা। এমন পরিস্থিতিতে বিপাকে পড়েছেন হাওরকেন্দ্রিক পর্যটনশিল্পকে জীবিকার মাধ্যম হিসেবে বেছে নেওয়া নৌকা ও স্পিডবোটের মালিক কর্মচারীসহ হোটেল-রেস্তোরাঁ, রিসোর্টের মালিক ও শ্রমিকেরা।

গতকাল শনিবার বিকেলে সরেজমিনে নিকলী সদরের বেড়িবাঁধ এলাকায় দেখা যায়, বেড়িবাঁধ এলাকায় ঘাটে সারি সারি বাঁধা শত শত নৌকা। কিন্তু মিলছে না পর্যটকের দেখা। এ সময় পর্যটকবাহী নৌকার মালিক ইব্রাহিম মিয়া বলেন, প্রায় আট লাখ টাকা খরচ করে তিনি বর্ষার এ সময়ে ব্যবসা করবেন বলে নৌকা তৈরি করেছেন। এই সময়টাই হলো তাঁদের ব্যবসার উপযুক্ত সময়। হাওর এখন পর্যটকে মুখর থাকার কথা। কিন্তু গত ৮-১০ দিন ধরে প্রায় পর্যটকশূন্যতায় পড়েছে হাওর। পর্যটকদের নিয়ে কোনো নৌকা বা স্পিডবোট হাওরে যেতে পারছে না। দেশের পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও শুক্র ও শনিবারও পর্যটকদের খুব বেশি দেখা মেলেনি।

এতে লাখ লাখ টাকায় নৌকা বানিয়ে এখন মাথায় হাত পড়েছে নৌকামালিকদের।
পারভেজ আহমেদ নামের আরেকজন নৌকার মালিক বলেন, শনিবার ছুটির দিনেও সকাল থেকে নিকলীর বেড়িবাঁধ এলাকায় ঘাটে সারিবদ্ধভাবে বাঁধা দুই শ থেকে তিন শ নৌকাসহ অনেক স্পিডবোট। আগের শুক্র ও শনিবার যেসব নৌকা বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে হাওরের ছাতিরচরের করচবন, মিঠামইনের অলওয়েদার সড়কসহ বিভিন্ন জায়গায় ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকায় ভাড়া যেত, এখন সেখানে ২ হাজার টাকায় গেলেও কোনো পর্যটক মিলছে না। এভাবে চলতে থাকলে অনেক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে নৌকার মালিকদের।

কিশোরগঞ্জের নিকলী সদরের বেড়িবাঁধ এলাকায় ঘাটে সারি সারি বাঁধা নৌকা। মিলছে না পর্যটকের দেখা
ছবি: প্রথম আলো

ঢাকার উত্তরা থেকে মোটরসাইকেলে দুই পর্যটক এসেছেন নিকলী হাওরে। এর মধ্যে নাইমুল ইসলাম নামের একজন বলেন, ‘ইউটিউবে দেখেছিলাম ছুটির দিনে নিকলী বেড়িবাঁধে মানুষের অনেক ভিড়। শনিবার এসে দেখলাম অনেকটাই ফাঁকা। মানুষের তেমন ভিড় চোখে পড়েনি। মানুষের ভিড় আর হইহুল্লোড় থাকলে যে মজাটা উপভোগ করা যায়, সেটা পাওয়া যাচ্ছে না।’

নিকলী বেড়িবাঁধ এলাকায় কথা হয় আল্লাহরদান নামের একটি খাবার হোটেলের মালিক শরিফ মিয়ার সঙ্গে। তাঁর দাবি, বর্ষার এ সময়টাতে শুক্র ও শনিবারে অন্তত ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার খাবার বিক্রি করা যেত। ছুটির এ দিনগুলোতে হোটেলে প্রচণ্ড ভিড় থাকত। কিন্তু এখন সারা দিনে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকার খাবারও বিক্রি করা যাচ্ছে না। হোটেলের শ্রমিকদের বেতন দিয়ে এভাবে আর চলছে না।

কিশোরগঞ্জ হাওরের বৈশিষ্ট হলো এখানে বছরের ছয় মাস পানি থাকে, বাকি সময়টা থাকে শুকনা। বর্ষায় হাওর হয়ে ওঠে অনেকটা কূলহীন। বিশাল জলরাশির বুকে বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোকে একেকটা ছোট দ্বীপের মতো মনে হয়। হাওরজুড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা হিজলগাছ আর পানির নিচ থেকে জেগে ওঠা করচের বন আর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সাদা শাপলা যেন সৌন্দর্যের ঝাঁপি মেলে বসে। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য বর্ষায় যেন সৌন্দর্যের সবটুকু দিয়ে পসরা সাজায় হাওর। তাই হাওর, বাঁওড় ও নদীর মায়াঘেরা অবারিত সৌন্দর্য উপভোগ করতে বর্ষায় কিশোরগঞ্জের হাওরের নিকলীর বেড়িবাঁধ, করচবন, করিমগঞ্জের বালিখলা, হাসানপুর সেতু, ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের আভুড়া সড়কে প্রতিদিন বেড়াতে যান হাজারো পর্যটক।

কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার কিশোরগঞ্জ জেলায় সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হয়েছে। পরিস্থিতি আস্তে আস্তে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসছে। দু–এক দিনের মধ্যে আশা করা যাচ্ছে পরিস্থিতি আরও ভালো হবে। তখন আগের মতো সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলবে। হাওরের পর্যটনশিল্পেও গতি ফিরে আসবে।