দোকানেই বসে ছিলেন, আচমকা গুলি এসে লাগে

অস্ত্রোপচারের পর হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরলেও সংসার ও দোকান চালানো নিয়ে শঙ্কিত গুলিবিদ্ধ দোকানি ইয়াকুব আলী। গত বুধবার সন্ধ্যায় হাটহাজারীর বুড়িশ্চর ইউনিয়নের তালুকদারপাড়ায়ছবি: প্রথম আলো

দোকানি ইয়াকুব আলী ক্ষত পা সোফার হাতলে রেখে বসে ছিলেন। পাশে স্ত্রী শামীমা আকতার তাঁর শুশ্রূষা করছিলেন। দুই পাশে দাঁড়িয়ে বাবার ক্ষত পায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলেন সন্তানেরা। তাদের বিমর্ষ চেহারায় ফুটে উঠছিল অনিশ্চয়তা।

ইয়াকুব আলীর (৫০) বাড়ি হাটহাজারী উপজেলার বুড়িশ্চর ইউনিয়নের তালুকদারপাড়ায়। ২৪ জুন বেলা দুইটার দিকে মদুনাঘাট পুলিশ ফাঁড়ি থেকে ‘ভুলবশত’ ছোড়া গুলি এসে তাঁর পায়ে লাগে। একই সময়ে পুলিশের ছোড়া গুলিতে আহত হন নুরুল আবসার (৪৩) নামের আরেক দোকানি। মদুনাঘাট পুলিশ ফাঁড়ি থেকে ৩০০ মিটার দূরের টেণ্ডলের ঘাটাবাজারে দুজনের দোকান রয়েছে। নুরুল আবসার দোকানে মুরগি বিক্রি করেন। ইয়াকুব আলীর দোকানটি কুলিং কর্নার। পাশাপাশি দোকান তাঁদের।

গুলিতে আহত হওয়ার পর দুজনই গত বুধবার হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরেন। এরপর ইয়াকুব আলীর বাড়িতে গিয়ে প্রতিবেশীদের জটলা চোখে পড়ে। নানা বয়সী মানুষ তাঁকে দেখতে আসছিলেন। কেউ সেদিনের ঘটনার বর্ণনা শুনছিলেন তাঁর মুখ থেকে, আবার কেউ তাঁর স্বাস্থ্যের খোঁজ নিচ্ছিলেন। এক ফাঁকে কথা হয় ইয়াকুব আলীর সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দোকানে বসে ছিলেন তিনি। হঠাৎ তাঁর বাঁ পায়ে একটি গুলি এসে লাগে। যন্ত্রণায় চোখে অন্ধকার নেমে আসে তাঁর। তিনি চিৎকার করতে থাকেন।

ইয়াকুব আলী বলেন, চিৎকার শুনে বাজারের লোকজন এগিয়ে আসেন। তাঁরা ধরাধরি করে বেসরকারি একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। চিকিৎসকেরা তাঁকে তিন থেকে ছয় মাস বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু এত দিন ঘরে বসে থাকলে তাঁর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। বড় ছেলের বয়স মাত্র ১৫ বছর। সে-ও দোকান চালাতে পারবে না। এর ফলে তাঁর সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল।

বাসায় স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে হাতে গুলিবিদ্ধ নুরুল আবসার। গত বুধবার সন্ধ্যায় বুড়িশ্চর ইউনিয়নের তালুকদারপাড়ায়
ছবি: প্রথম আলো

ইয়াকুব আলীর স্ত্রী শামীমা আকতার স্বামীর এ অবস্থায় পুরোপুরি ভেঙে পড়েছেন। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় চোখ ছলছল করছিল তাঁর। নিজেকে কোনোমতে সামলে তিনি বলেন, তাঁদের এক ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় ছেলের বয়স ১৫। পুরো পরিবার চলে স্বামীর একার আয়ে। কিন্তু তাঁর স্বামী চিকিৎসাধীন। এর ফলে কীভাবে সংসার চলবে, বুঝতে পারছেন না।

হাত নাড়াতে পারছেন না নুরুল আবসার

ইয়াকুব আলীর বাড়ি থেকে ৫০০ মিটার দূরত্বেই থাকেন নুরুল আবসার। একচালা টিনঘেরা বাড়ি তাঁর। বুধবার তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে স্বজন ও প্রতিবেশীরা ভিড় করেছেন। খাটে শোয়া ছিলেন নুরুল আবসার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ডান হাতে দুটি গুলি লেগেছে। বেশ ক্ষত হয়ে গেছে। চিকিৎসা চলছে। সুস্থ হতে অন্তত ছয় মাস লাগতে পারে।

নুরুল আবসারের তিন সন্তান। বড় ছেলের বয়স আট বছর। মুরগি বিক্রি করে সংসার চলত তাঁর। বর্তমানে দোকান বন্ধ। এতে দিশাহারা অবস্থা পরিবারটির। নুরুল আবসারের স্ত্রী আফরোজা আকতার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্বামী বিছানায় পড়ে থাকলে সংসার চলবে না। এর ফলে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তাঁদের।

তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ

অস্ত্র পরীক্ষা করার সময় ‘ভুলবশত’ পুলিশ ফাঁড়ি থেকে ছোড়া গুলিতে ওই দুই দোকানি আহত হওয়ার পর তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা পুলিশ। বুধবার এ কমিটি গঠন করা হয় বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে। তদন্ত কমিটি গঠনের পর বুধবার বিকেলে ইয়াকুব আলী ও নুরুল আবসারের বাড়িতে তদন্তে যান পুলিশের তদন্ত কমিটির সদস্যরা।

পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটি বেসরকারি ব্যাংকের শটগান পুলিশ ফাঁড়িতে এনে গুলি ছোড়ার কাজ পরীক্ষা করছিলেন এক কনস্টেবল ও ব্যাংকের এক নিরাপত্তাকর্মী। তাঁদের আকাশের দিকে ছোড়া গুলি কীভাবে দুজনের গায়ে পড়েছে, তা বের করতে ওই তদন্ত কমিটি কাজ করছে। আপাতত গুলিবিদ্ধ দুই দোকানির চিকিৎসার ব্যয় পুলিশের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে।

জানতে চাইলে মদুনাঘাট তদন্তকেন্দ্রের পুলিশ পরিদর্শক মহিউদ্দিন সুমন প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। এ ছাড়া গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিদের পরিবারকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে।