বরিশালে ব্যবস্থাপনা কমিটির দ্বন্দ্বে ৫০২ বিদ্যালয়ে মামলা
১৬ বছর ধরে বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাপনা কমিটি নেই। কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বে ৫০২ বিদ্যালয়ে মামলা। এর প্রভাব পড়ছে শিক্ষাক্ষেত্রে।
বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি নিয়ে বরিশাল বিভাগের অন্তত ৫০০ বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দ্বন্দ্ব চলছে। এই বিরোধের জেরে শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলি, বরখাস্ত এবং পাল্টাপাল্টি মামলায় জর্জরিত এসব বিদ্যালয়।
বরিশাল শিক্ষা বোর্ড সূত্র জানায়, এই শিক্ষা বোর্ডের অধীন ১ হাজার ৮০০ মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ৫০২টি বিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বে দলাদলি, মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৮৬টি মামলা উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। নিম্ন আদালতে অনেক মামলা থাকলেও তার হিসাব শিক্ষা বোর্ডের কাছে নেই। শিক্ষা বোর্ডের পক্ষ থেকে এসব বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা ফলপ্রসূ হচ্ছে না।
উচ্চ আদালতে ৮৬টি মামলা ছিল। এর মধ্যে গত এক বছরে আমরা ২১টি মামলার নিষ্পত্তি করিয়েছি। বাকিগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির চেষ্টা আছে।
বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যালয়গুলোর এই দ্বন্দ্ব ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতৃত্ব নিয়ে। কমিটিতে কে আসবেন, কে আসতে পারবেন না—এ নিয়েই বিরোধের শুরু হয়। এর বাইরে দাতা সদস্য, বিদ্যানুরাগী সদস্য নিয়েও দ্বন্দ্ব রয়েছে। এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে যে স্থানীয় প্রভাবে যাঁরা বিদ্যালয়ের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ও দাতা, তাঁদেরও কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। অনেক সময় স্বার্থান্বেষী মহল প্রধান শিক্ষকের সহযোগিতায় গোপনে পরিচালনা কমিটি গঠন করেন। আবার স্থানীয় প্রভাবশালীরা কমিটি নিয়ে পরস্পর দ্বন্দ্বে জড়ান। এতে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় পাশাপাশি মামলা চালাতে ব্যয় করতে হচ্ছে বিদ্যালয়ের তহবিলের অর্থ।
বিভিন্ন বিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মূলত বিদ্যালয়ের সম্পদ এবং স্থানীয়ভাবে নানা ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতেই বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটি নিজেদের কবজায় নিতে চান এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এর পেছনে তাঁদের মূল শক্তি হিসেবে কাজ করেন রাজনৈতিক নেতারা।
বরিশাল নগরের প্রাণকেন্দ্র ও বাণিজ্যিক এলাকা গির্জা মহল্লায় প্রায় দুই একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এ কে (আসমত আলী খান) ইনস্টিটিউশন। বিদ্যালয়টির সামনের বাণিজ্যিক স্থাপনা থেকে মাসিক ছয় লাখ টাকা ভাড়া আসে। ২০২০ সালের ২৭ জুলাই এই বিদ্যালয়টির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হন মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসান মাহমুদ। তিনি বিদ্যালয়ের তহবিল নানাভাবে তছরুপ শুরু করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে বাধা দেওয়ায় ওই বছরের ২৭ ডিসেম্বর বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক এইচ এম জসিম উদ্দীনকে সাময়িক বরখাস্ত করেন তিনি। এরপর প্রধান শিক্ষক এই সাময়িক বরখস্তের আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট করেন। এরপর প্রায় সাড়ে চার বছর পর আদালতের রায়ে প্রধান শিক্ষক পদে বহাল হন।
এ বিষয়ে এইচ এম জসিম উদ্দীন বলেন, ‘আমি পুনরায় যোগদান করার পর প্রাথমিক একটি অডিট করে যে তথ্য পেয়েছি, তাতে গত চার বছরে এক কোটি টাকার বেশি অর্থ তহবিল থেকে তছরুপ হয়েছে। নতুন কমিটি আসার পরে বিষয়টি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিদ্যালয়ে গত চার বছর লুটপাট, দলাদলির কারণে শিক্ষার মান নিম্নমুখী হয়েছে। এ কারণে অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয় ছেড়ে গেছে।’
শিক্ষকেরা বলছেন, বিদ্যালয়গুলোতে পরিচালনা কমিটি নিয়ে বিরোধ-মামলায় প্রধান শিক্ষকসহ সাধারণ শিক্ষক ও কর্মচারী বরখাস্তের ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। এর মধ্যে পাল্টাপাল্টি মামলায় জড়িয়ে কারাবাসসহ নানাভাবে শিক্ষকেরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অনেকে অন্যায়ভাবে বরখাস্ত হয়েছেন। শিক্ষকতা করতে এসে পাঠদান রেখে শিক্ষকদের আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে। এ জন্য শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
আমি পুনরায় যোগদান করার পর প্রাথমিক একটি অডিট করে যে তথ্য পেয়েছি, তাতে গত চার বছরে এক কোটি টাকার বেশি অর্থ তহবিল থেকে তছরুপ হয়েছে। নতুন কমিটি আসার পরে বিষয়টি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিদ্যালয়ে গত চার বছর লুটপাট, দলাদলির কারণে শিক্ষার মান নিম্নমুখী হয়েছে। এ কারণে অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয় ছেড়ে গেছে।প্রধান শিক্ষক এইচ এম জসিম উদ্দীন
বোর্ড সূত্র জানায়, ১৬ বছর ধরে বরিশাল বিভাগের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাপনা কমিটি নেই। মনোনীত অ্যাডহক কমিটি দিয়েই বেশির ভাগ বিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে। অ্যাডহক কমিটির মেয়াদ ছয় মাস। বারবার রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজেদের লোকদের মনোনীত করে অ্যাডহক কমিটি করে এত দিন বিদ্যালয়গুলো পরিচালনা করেছেন। আর এ নিয়েই প্রধান শিক্ষক কিংবা স্থানীয় প্রভাবশালীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং মামলা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন প্রধান শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা হলে তার প্রভাব শিক্ষার্থীসহ সবার ওপর পড়ে। এ ক্ষেত্রে সরকারের নতুন করে চিন্তাভাবনা করা দরকার। পাশাপাশি বিদ্যালয়সংক্রান্ত মামলা গ্রহণের আগে তা যাচাই-বাছাইয়ের ব্যবস্থা থাকা দরকার।
বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ইউনুস আলী সিদ্দিকী প্রথম আলোক বলেন, ‘উচ্চ আদালতের ৮৬টি মামলা ছিল। এর মধ্যে গত এক বছরে আমরা ২১টি মামলার নিষ্পত্তি করিয়েছি। বাকিগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির চেষ্টা আছে।’