‘ছাওয়া ছাড়ি মুই ক্যামনে বাঁচিম’

একমাত্র উপার্জনকারী মনিরকে হারিয়ে শোকাহত তাঁর পরিবারের সদস্যরা। গতকাল শনিবার বগুড়ার ধুনট উপজেলার কালেরপাড়া ইউনিয়নের আনারপুর গ্রামেছবি: প্রথম আলো

বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ছনকা এলাকায় রপ্তানিমুখী পণ্য ‘স্বর্ণা’ ব্র্যান্ডের চালের কুঁড়ার তেল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মজুমদার প্রোডাক্টসের কারখানায় বিস্ফোরণে নিহত চার শ্রমিকই তাঁদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন। তাঁদের হারিয়ে পরিবারের সদস্যরা মুষড়ে পড়েছেন। কীভাবে সংসার চলবে, তা নিয়ে চিন্তায় আছেন তাঁরা।

গত শুক্রবার বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে চারজনের লাশ তাঁদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। লাশ নিতে আসা স্বজনদের আহাজারিতে হাসপাতাল এলাকায় শোকাবহ পরিবেশ তৈরি হয়। নিহত শ্রমিক রুবেল মিঞার লাশ নেওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন তাঁর ষাটোর্ধ্ব মা মিন্নি বেগম। তাঁর সঙ্গে ছিলেন রুবেল মিঞার স্ত্রী আশামণি, একমাত্র বোন মুন্নি খাতুন ও দুই বছরের কন্যা রিয়ামণি। সেখানে আহাজারি করতে করতে মিন্নি বেগম বলেন, ‘মোর ছাওয়া কই গেইল। ছাওয়া ছাড়া মুই ক্যামনে বাঁচিম।’

বৃহস্পতিবার বেলা একটার দিকে মজুমদার প্রোডাক্টসের কারখানায় যন্ত্রাংশ মেরামতকালে তেলের ট্যাংকি বিস্ফোরণে চার শ্রমিক মারা যান। তাঁরা কারখানায় তেলের পাইপলাইন ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করছিলেন। তাঁরা নীলফামারীর সৈয়দপুরের এমজি মেটাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক ছিলেন।

নিহত চার শ্রমিক হলেন রংপুরের হারাগাছ উপজেলার সারাই গ্রামের তৌহিদ উদ্দিনের ছেলে রুবেল মিঞা (৩৫), নীলফামারীর সৈয়দপুর হাতিখানা বিহারি কলোনি এলাকার সোলায়মান আলীর ছেলে আবু সাঈদ (২৮), খলিলুর রহমানের ছেলে মুরাদ হোসেন (৩৯) ও বগুড়ার ধুনট উপজেলার কালেরপাড়া ইউনিয়নের আনারপুর গ্রামের আশরাফ আলী প্রামাণিকের ছেলে মনির হোসেন (২৮)।

হাসপাতালের মর্গে আলাপকালে নিহত রুবেলের বোন মুন্নি খাতুন বলেন, তাঁর বাবা তৌহিদ উদ্দিন পেশায় সেলুনশ্রমিক। তাঁরা বয়স হয়েছে, প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। রুবেল প্রতি মাসে গড়ে ১৫–১৬ হাজার টাকা উপার্জন করতেন। অর্ধেক টাকা মায়ের কাছে পাঠাতেন, খরচ চালানো ও ওষুধ কেনার জন্য। বাকি অর্ধেক স্ত্রীর কাছে পাঠাতেন সংসার খরচের জন্য। মুন্নি আরও বলেন, ‘গত মঙ্গলবার ভাইডা হামার মোবাইলে ফোন করি কচ্চিল, রিয়ামণির জন্মদিন অনুষ্ঠান করমো। তুমি জামাইকে লিয়ে চলে আসিয়ো।’

আরও পড়ুন

রুবেলের স্ত্রী আশামণি বলেন, চার বছর আগে রুবেলের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ঘরে দুই বছরের কন্যা। মাস ছয়েক আগে শেরপুরে মজুমদার প্রোডাক্টস কারখানায় ঝালাইয়ের কাজে আসেন। দীর্ঘদিন হলো বাড়িও যান না। খুব ইচ্ছে ছিল মেয়ের জন্মদিনে এবার অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল।

মনিরের বাড়িতে মাতম

ধুনটের কালেরপাড়া ইউনিয়নের আনারপুর গ্রামের আশরাফ আলী প্রামাণিকের দুই ছেলে। সংসারে অভাবের কারণে উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় বড় ছেলে মনির হোসেনের। বেছে নেন ঝালাই মিস্তির কাজ। তাঁর উপার্জনেই চলত সংসার। ছোট ভাই ও ছোট বোনের পড়ালেখার খরচ তিনিই চালাতেন। শনিবার মনিরদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছেলের শোকে মা বুলবুলি খাতুন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ছোট বোন আয়েশা ভাইয়ের শোকে বিলাপ করছেন। ছোট ভাই আতাউর রহমানও মুষড়ে পড়েছেন।

নিহত মনিরের ছোট চাচা মোহাম্মদ এরশাদ আলী বলেন, কারখানা কর্তৃপক্ষের কোনো গাফিলাতি ছিল কি না, তা নিশ্চিত নয়। তবে মামলা চালানোর মতো সামর্থ্য তাঁদের নেই। এ কারণে কারখানার মালিকের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা হয়নি।

অভাবের কারণে মামা পড়ালেখা করতে পারেননি। তাঁর উপার্জনে সংসার চলত। মামাকে হারিয়ে নানি সামিনা বেগম পাগলপ্রায়।
মো. আরজু, নিহত সাঈদের ভাগনে
নিহত মনির হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

বেশি উপার্জনের আশায় ওয়েল্ডিংয়ের কাজ নিয়েছিলেন আবু সাঈদ

নীলফামারীর সৈয়দপুর হাতিখানা বিহারি কোলনিতে বড় হয়েছেন আবু সাঈদ। দুই বোন চার ভাইয়ের মধ্যে সংসারের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে পড়ে ছিল। একসময় তিনি রিকশা চালাতেন। সেই উপার্জনে সংসার চলত না। পরে কাজ নেন বালতি কারখানায়, সেটাও পোষাচ্ছিল না। এরপর বেশি উপার্জনের আশায় কয়েক মাস আগে শেরপুরে ওই কারাখানায় ওয়েল্ডিং মিস্ত্রির কাজ নিয়েছিলেন। সাঈদের ভাগনে মো. আরজু বলেন, অভাবের কারণে মামা পড়ালেখা করতে পারেননি। তাঁর উপার্জনে সংসার চলত। মামাকে হারিয়ে নানি সামিনা বেগম পাগলপ্রায়।

মুরাদের মৃত্যুতে পরিবারে অনিশ্চয়তা

বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা ছাড়াও তিন ভাই ও এক বোন আছেন মুরাদের পরিবারে। তাঁর আয়েই চলত পুরো পরিবার। ছোট ভাই মো. ওমর বলেন, বিস্ফোরণে ভাই নিহত হওয়ায় সংসারে চরম অনিশ্চয়তা নেমে এসেছে। এখন দিশেহারা পুরো পরিবার।

তদন্ত কমিটি

বিস্ফোরণে চার শ্রমিক নিহতের ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে লিখিত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। শেরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুমন জেহাদী প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিকভাবে দেখা যায়, কারখানায় যাঁরা কাজ করছিলেন, তাঁরা শ্রমিক ছিলেন। কোনো টেকনিশিয়ান বা  ইঞ্জিনিয়ার কিংবা অভিজ্ঞ কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন কাউকে সেখানে পাওয়া যায়নি।

শেরপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, নিহত শ্রমিকদের পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ মামলা করতে রাজি হননি। ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনদের কাছে চারজনের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে।

আরও পড়ুন