উজিরপুরে বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের দিয়ে ঘরবাড়ি ভাঙচুর, ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা
বরিশালের উজিরপুর উপজেলায় বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দিয়ে হামলা চালিয়ে দুটি পরিবারের বসতঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও সাবেক এক ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে। এ সময় বাড়ির লোকজনকে পিটিয়ে জখম ও ঘরের মালামাল লুট করা হয়েছে বলে পরিবারগুলো অভিযোগ করেছে। এ ঘটনায় আজ সোমবার এই তিন ব্যক্তিসহ ১৪ জনকে আসামি করে থানায় একটি মামলা হয়েছে।
গতকাল রোববার সকালে উপজেলার শোলক গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। শোলক ভিক্টোরিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন ও শোলক ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য আফজাল হোসেন হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে পরিবারগুলোর অভিযোগ। তবে তাঁরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী, স্থানীয় লোকজন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৮৯৯ সালে মহারানি ভিক্টোরিয়ার নামে উজিরপুরের শোলক গ্রামের জমিদার মনোরঞ্জন মুখার্জি জমি দান করে ‘শোলক ভিক্টোরিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য ৮০ বছর আগে আসমত আলী হাওলাদার নামের এক ব্যক্তিকে ৪০ শতাংশ জমির ভোগদখল বুঝিয়ে দেন ওই জমিদার। বর্তমানে জমিটিতে আসমত আলীর দুই মেয়ে ফিরোজা বেগম (৭৫) ও উজিরন বেগম (৭০) সপরিবার বসবাস করছেন।
কিছুদিন ধরে শোলক ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য আফজাল হোসেন ও তাঁর ভাই আসাদুর রহমান জমিটি দখলে নেওয়ার চেষ্টা করেন। সেটি না পেরে আফজাল হোসেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোজাম্মেল হোসেন ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিনের কাছ থেকে ওই জমিটি ইজারা হিসেবে নেন। একই সময়ে পরিবার দুটিও দাবি করেছে, তাদের কাছে জমির দলিলপত্র আছে। গতকাল রোববার সকালে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোজাম্মেল হোসেন, সভাপতি জসিম উদ্দিন ও সাবেক ইউপি সদস্য আফজাল হোসেন নেতৃত্বে বিদ্যালয়ের দুই শতাধিক ছাত্রছাত্রী, কমিটির সদস্য ও শিক্ষকেরা জমি দখলে নিতে যান।
প্রয়াত আসমত আলীর মেয়ে শোলক গ্রামের সিদ্দিক হাওলাদারের স্ত্রী ফিরোজা বেগম বলেন, গতকাল সকালে এই তিন ব্যক্তি ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এসে বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট শুরু করেন। বাধা দিলে পিটিয়ে ও কুপিয়ে তাঁর বোন উজিরন বেগম (৭০), স্বামী সিদ্দিক হাওলাদার (৭৫), ছেলে ইমন হাওলাদারসহ (১৮) চারজনকে জখম করেন তাঁরা। হামলাকারীরা প্রায় তিন-চার ঘণ্টায় দুই পরিবারের বসতঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেন।
আসমত আলীর আরেক মেয়ে উজিরন বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘মোর বাবা-মা এই বাড়িতে ৯০ বছর বসবাস করে মারা যায়। মোগো দুই বোনের জন্ম হয় এই বাড়িতে। ৭০-৭৫ বছর যাবৎ মোরা এহানে বসবাস করি। এত বছরের সংসার ছাত্রগো দিয়ে শেষ কইরা দিল। এহন মোরা কই যামু। শিক্ষিত মানুষ হইয়া স্যারেরা অশিক্ষিতের মতো কাম করছে। দেশে কোনো আইন, বিচার নাই। মোগো গরিবের উপর জুলুম কইররা বাড়িঘর ভাইঙ্গা দহল নিল, কেউ দেহার নাই।’
এই পরিবার দুটি অন্তত ৮০ বছর ধরে এই জমিতে বসবাস করছেন জানিয়ে শোলক গ্রামের প্রবীণ নাজমুল নাহার বেগম বলেন, হামলা চালিয়ে দুটি পরিবারকে নিঃস্ব করে দেওয়া হয়েছে। স্কুলের বৈধ জমি হলে আইন আছে, আদালত আছে। সেটির মাধ্যমে দখল করা যেত। কিন্তু তা না করে গায়ের জোরে বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিশুদের ব্যবহার করে জমি দখল করা হয়েছে।
প্রধান শিক্ষক মো. মোজাম্মেল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জমির মালিক স্কুল। দখলদারদের অন্যত্র চলে যেতে বলা হলেও তাঁরা কর্ণপাত করেননি। পরবর্তী সময়ে জমি ইজারা দেওয়া হয়েছে। অভিভাবকেরা মাইকিং করে জমি উদ্ধারে ছাত্রছাত্রীদের সহায়তা আহ্বান করেন। অভিভাবকেরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে স্কুলের জমি দখলমুক্ত করেছেন। এর সঙ্গে তিনি জড়িত নন। বিদ্যালয় জমির বৈধ মালিক হলে আইন-প্রশাসনকে বাদ দিয়ে বিনা নোটিশে ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে হামলা চালানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘ঘটনার সঙ্গে আমি সম্পৃক্ত না। অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীরা স্কুলের জমি দখলমুক্ত করেছেন। লুটপাটের অভিযোগ সত্য না।’ আর সাবেক ইউপি সদস্য আফজাল হোসেনের বলেন, ‘আমি স্কুলের কাছ থেকে লিজ নিয়েছি। স্কুল আমাকে দখল দিয়েছে।’
উজিরপুর মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (ওসি তদন্ত) মো. তৌহিদুজ্জামান বলেন, বিদ্যালয়ের সভাপতি, প্রধান শিক্ষক ও সাবেক ইউপি সদস্য আফজাল হোসেনের নেতৃত্বে বেআইনিভাবে বাড়িঘর ভাঙচুর করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে দুটি হতদরিদ্র পরিবারকে আশ্রয়হীন করা হয়েছে, যা খুবই অমানবিক। এ ঘটনায় সোমবার থানায় একটি মামলা হয়েছে।