ক্ষমতার দাপট—১
সংসদ সদস্য পংকজের ‘পীড়নে’ অতিষ্ঠ আওয়ামী লীগ
সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকেই নিজস্ব বলয় তৈরি করেন পংকজ নাথ। গত ১০ বছর নানাভাবে দমন-পীড়নের শিকার আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা।
বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পংকজ নাথের বিরুদ্ধে দলের প্রার্থীর বিপক্ষে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী দাঁড় করানো, বিপক্ষে গেলে হামলা চালিয়ে হাত-পা ভেঙে দেওয়া ও কোপানোর হুমকিসহ নানা অভিযোগ করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা।
বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগে ২০১৯ সালে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের পদ হারান পংকজ নাথ। শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে তাঁকে দলের সব স্তরের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সর্বশেষ দলের প্রয়াত নেতাকে নিয়ে বিষোদ্গার করে আলোচনায় এসেছেন এই সংসদ সদস্য।
পংকজ নাথের বিভাজনের রাজনীতির কারণে গত ১০ বছরে অন্তত ১০ জন দলীয় কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন অভিযোগ করে মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কামাল আহম্মেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, দলের সব পদ থেকে পংকজ নাথকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এর আগে থেকেই তিনি ‘ব্যক্তি লীগ’ প্রতিষ্ঠা করে আওয়ামী লীগ নিধনের মিশন চালিয়ে আসছেন। দুটি উপজেলা ও আটটি ইউনিয়নের দলীয় প্রার্থীদের পরাজিত করিয়েছেন। যখন যাঁকে ইচ্ছা মারছেন, কোপানোর হুমকি দিচ্ছেন, নৌকার প্রার্থীকে হারিয়ে দিচ্ছেন, খুনখারাবি করছেন।
অবশ্য অনুসারীদের দাবি, পংকজ নাথ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা সুভাষ চন্দ্র সরকারের মতে, দলীয় নেতা-কর্মীরা পংকজ নাথের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় বিরোধিতা করছেন। তবে জনসমর্থন পংকজ নাথের দিকে। বরিশাল জেলা নেতাদের প্রতিহিংসার শিকার তিনি। কারণ, তাঁর সমকক্ষ নেতা এখানে নেই। তিনি যাতে বেড়ে উঠতে না পারেন, সেজন্য তাঁকে দমিয়ে রাখা হচ্ছে।
উপজেলা-ইউপিতে বিদ্রোহী প্রার্থী
গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মেহেন্দীগঞ্জ ও হিজলায় দলীয় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করার অভিযোগ রয়েছে পংকজ নাথের বিরুদ্ধে। মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা পরিষদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন জেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনসুর আহমেদ; কিন্তু পংকজ সমর্থন দেন ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ মাহফুজুল ইসলামকে। নৌকার প্রার্থীকে হারিয়ে মাহফুজুল ইসলাম জয়ী হন।
হিজলা উপজেলা পরিষদের নির্বাচনেও পংকজ নাথের ‘সমর্থনে’ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী বেলায়েত ঢালী। সেখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান মাহমুদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিনি দলটাকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। এখানে আমার বিপক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়ে উপজেলা পরিষদে আমাকে জোরজবরদস্তি করে হারিয়ে দিয়েছেন।’
আমার নির্বাচনী এলাকায় পারিবারিক দ্বন্দ্বে কেউ মারা গেলে কিংবা দুর্ঘটনায় মারা গেলেও সেগুলো হত্যাকাণ্ড বানানো হয়েছে, এসবের দায় আমার ওপরে চাপানোর অপচেষ্টা হয়েছে।
একইভাবে মেহেন্দীগঞ্জের ২১টি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) মধ্যে ছয়টিতে নৌকার প্রার্থীকে হারিয়ে দেন পংকজ নাথের সমর্থন পাওয়া দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা।
অভিযোগ প্রসঙ্গে পঙ্কজ নাথ গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, যেসব প্রার্থী বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচনে জয়ী বা পরাজিত হয়েছেন, তাঁদের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান থেকেই বোঝা যায়, তাঁরা কাদের মদদে দলের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছিলেন।
আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘাত
মেহেন্দীগঞ্জের পুরোনো উলানিয়া ইউনিয়নকে বিভক্ত করে উত্তর ও দক্ষিণ উলানিয়া নামে দুটি পৃথক ইউনিয়ন গঠন করা হয়। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর এই দুই ইউপিতে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সীমানা-জটিলতা মামলায় নির্বাচন স্থগিত হয়। দুটি ইউনিয়নেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বাইরে পঙ্কজ স্বতন্ত্র প্রার্থী দেন। এর জের ধরে ২০২১ সালের ২০ মে উত্তর উলানিয়ার শোলদি গ্রামে সংঘর্ষ হয়। এতে সিদ্দিকুর রহমান (৩০) ও ছত্তার ঢালী (৫৫) নামে দুজন আওয়ামী লীগ কর্মী নিহত হন। তাঁরা স্থগিত হওয়া নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী নুরুল ইসলাম মোল্লার সমর্থক ছিলেন। সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথের সমর্থক ‘বিদ্রোহী’ চেয়ারম্যান প্রার্থী নুরুল ইসলাম চৌধুরীর সমর্থকেরা এই হামলা চালান বলে অভিযোগ।
তিনি (পংকজ নাথ) ‘ব্যক্তি লীগ’ প্রতিষ্ঠা করে আওয়ামী লীগ নিধনের মিশন চালিয়ে আসছেন। দুটি উপজেলা ও আটটি ইউনিয়নের দলীয় প্রার্থীদের পরাজিত করিয়েছেন।
ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছে ডিবি। মামলার ১৮ আসামির অনেকে জামিনে আছেন, আবার বেশ কয়েকজন জামিন নেননি। কিন্তু এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ বাদীপক্ষের। নিহত আবদুস ছত্তার ঢালীর ভাই জামাল ঢালি হিজলার ধূলখোলা ইউপির আওয়ামী লীগ–দলীয় চেয়ারম্যান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৯ নভেম্বর রাতে পংকজ নাথ ধূলখোলা ইউনিয়নের আলীগঞ্জ বাজারে সমাবেশ করেন। সেখানে তাঁর দুপাশে হত্যা মামলার আসামিদের অনেকে ছিলেন।
২০২১ সালের ১০ এপ্রিল ভোরে দক্ষিণ উলানিয়ায় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে দুজন নিহত হন। দক্ষিণ উলানিয়া ইউপির স্থগিত নির্বাচনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী মিলন চৌধুরী ও ‘বিদ্রোহী’ রুমা বেগম সরদারের সমর্থকদের মধ্যে এই সংঘর্ষে হয়েছিল। এতে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মিলন চৌধুরীর চাচাতো ভাই শহিদ চৌধুরী (৩৫) ও রুমা বেগমের সমর্থক সাইফুল ইসলাম সরদার (২৮) নিহত হন।
এ প্রসঙ্গে পঙ্কজ নাথ বলেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকায় পারিবারিক দ্বন্দ্বে কেউ মারা গেলে কিংবা দুর্ঘটনায় মারা গেলেও সেগুলো হত্যাকাণ্ড বানানো হয়েছে, এসবের দায় আমার ওপরে চাপানোর অপচেষ্টা হয়েছে।’
দুর্নীতির অভিযোগ তোলায় হামলা
২০১৫ সালে মেহেন্দীগঞ্জের ৯টি কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৮ জন সহকারী শিক্ষক নিয়োগ হয়। এতে পংকজ নাথের ভাইয়ের স্ত্রীও নিয়োগ পান। ওই নিয়োগে অনিয়ম ও অর্থ আদায়ের অভিযোগ তোলেন কাজিরহাট থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সঞ্জয় চন্দ্র। এ ঘটনায় পঙ্কজ নাথের ভাইয়ের স্ত্রীসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৭ সালের ৫ মার্চ আদালতে মামলা করেন সঞ্জয়। তিনি বলেন, মামলা করায় সংসদ সদস্য তাঁর লোক দিয়ে ওই বছরের ২০ এপ্রিল তাঁ দুই পা ও একটি হাত ভেঙে দেন। ছিনতাই মামলা দিয়ে তাঁকে জেলে পাঠান। ৫৮ দিন কারাভোগ করেন। ২০১৮ সালের ১২ জুন তাঁকে মেহেন্দীগঞ্জ নতুন ডাকবাংলোতে ধরে নিয়ে আবার মারধর করে বস্তায় ভরে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় তিনি পংকজ নাথকে আসামি করে মামলাও করেন। ২০২০ সালে আবার তাঁকে মারধর করে এলাকাছাড়া করা হয়, এমনকি পাঁচটি মিথ্যা মামলাও করা হয়েছিল।
তবে পংকজ নাথ দাবি করেন, সঞ্চয় শীল তাঁর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় সাধারণ লোকজন তাঁকে মারধর করেছেন। দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি সুপারিশ করেছি। এটা তো দুর্নীতি হতে পারে না।’
নেতাদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য ও হুমকি
গত বছরের জুলাই মাসে পংকজ নাথের সঙ্গে মুঠোফোনে এক পুলিশ কর্মকর্তার কথোপকথনের একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। অডিওতে পংকজ নাথের কণ্ঠে বলতে শোনা যায়, মেহেন্দীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কামাল খানসহ যে সামনে পড়বে, তাকেই কোপানোর জন্য তিনি অনুসারীদের নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন। গত ১৯ অক্টোবর উলানিয়া বাজার এলাকায় একটি পথসভায় পংকজ নাথের দেওয়া একটি বক্তব্য নিয়েও বিতর্কের সৃষ্টি হয়। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত মহিউদ্দীন আহম্মেদের সমালোচনা করে পঙ্কজ বলেন, বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর ঢাকায় এমপি হোস্টেলে হাঁসের মাংস ও খিচুড়ি খেয়ে আমোদ-ফুর্তি করেছিলেন মহিউদ্দীন আহম্মেদ। আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য এর সাক্ষী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মহিউদ্দীন আহম্মেদের সহযোগীরা মেহেন্দীগঞ্জ ও বরিশালে বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙচুর করেন। এখন তাঁরাই মেহেন্দীগঞ্জে আওয়ামী লীগ করছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মহিউদ্দীন আহম্মেদের মেয়ে শাম্মী আহম্মেদ বর্তমানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক। বড় ছেলে সাহাব আহম্মেদ মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। বরিশাল-৪ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী শাম্মী আহম্মেদ। পংকজের এ মন্তব্যে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। বক্তব্যকে নোংরা ও জঘন্য মিথ্যাচার উল্লেখ করে শাম্মী আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘বরিশালের মানুষ জানেন আমার বাবা কে ছিলেন, তাঁর রাজনৈতিক ভূমিকা কী ছিল।