কোন পর্যায়ে আছে শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলা মামলার বিচার
বরাবরের মতো এবারও দেশে পবিত্র ঈদুল ফিতরের বৃহত্তম জামাত আয়োজনে প্রস্তুত কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান। লাখ লাখ মুসল্লিকে স্বাগত জানাতে ইতিমধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। তবে ঈদুল ফিতর এলেই শোলাকিয়ায় ২০১৬ সালের সেই ভয়াবহ জঙ্গি হামলার প্রসঙ্গ সামনে চলে আসে। সেদিনের মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ এখনো ভেসে আসে স্থানীয় মানুষের কানে। তাঁরা ভুলতে পারেননি ভয়াবহ দুঃসহ সেই স্মৃতি। আর নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা এখনো ঘুরছেন বিচারের আশায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার ঘটনায় করা মামলাটি বর্তমানে সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনাল-২ আদালতে বিচারাধীন। বিচার কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরে আটকে ছিল। গত বছরের ২৯ আগস্ট মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। ওই দিন জেলার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলার পাঁচজন আসামিকে হাজির করা হয়েছিল। তাঁরা হলেন জেএমবির শীর্ষ জঙ্গি জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, মো. সবুর খান ওরফে সোহেল, জাহেদুল হক ওরফে তানিম এবং আনোয়ার হোসেন। তাঁদের উপস্থিতিতে বাদীসহ সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু করেন বিচারক। এ পর্যন্ত পাঁচ আসামির সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
কিশোরগঞ্জ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবু নাসের মো. ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনার সাত বছর পরে হলেও সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হওয়ায় অনেকটা স্বস্তি এসেছে। এখন দ্রুত মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ করা হবে এবং দোষী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হবে বলে আমরা আশা করছি।’
২০১৬ সালের ৭ জুলাই ছিল ঈদুল ফিতরের দিন। কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের অদূরে আজিম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে পুলিশের ওপর হামলা চালায় জঙ্গিরা। নির্মমভাবে চাপাতি ও কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে পুলিশের দুই কনস্টেবলকে। পরে জঙ্গিরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ সময় একটি গুলি লাগে এলাকার গৃহবধূ ঝর্ণা রাণীর দেহে। সেখানেই মারা যান তিনি।
নিহত ব্যক্তিদের স্বজন ও স্থানীয় মানুষের দাবি, শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের ঐতিহ্য ও মর্যাদা রক্ষায় দ্রুত এ মামলার বিচারকার্য শেষ করে দোষী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা উচিত।
নিহত ঝর্ণা রাণীর স্বামী গৌরাঙ্গ নাথ ভৌমিক এ হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার দাবি করে জানান, এ ঘটনায় তাঁর পুরো পরিবার তছনছ হয়ে গেছে। সাত বছর হয়ে গেলেও এ ভয়াবহ হামলার ঘটনার ক্ষত এখনো শুকায়নি। তিনি বলেন, ‘আজও কানে বাজে মুহুর্মুহু সেই গুলির আওয়াজ। আমার পরিবার এখনো ভুলতে পারছে না সেই দুঃসহ ভয়াবহ স্মৃতি। দুই ছেলে শুভদেব ও বাসুদেবকে এই দুঃখ–কষ্ট এখনো তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারছি না স্বজন হারানোর বেদনা। তাই স্ত্রী হত্যার দ্রুত বিচার দাবি করছি।’
মামলা ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে ঘটনার বিষয়ে জানা যায়, ওই বছরের ঈদুল ফিতরের দিন নামাজ শুরুর আগমুহূর্তে শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের অদূরে আজিম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের কাছে পুলিশের তল্লাশির সময় জঙ্গিরা গ্রেনেড হামলা করে। এ সময় তাদের চাপাতির কোপে পুলিশের দুই কনস্টেবল আনছারুল হক ও জহিরুল ইসলাম মারা যান। এ সময় আরও ১২ পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে ঘটনাস্থলেই আবির রহমান নামের এক জঙ্গি নিহত হন। উভয় পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে নিজ বাসায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ঝর্ণা রাণী ভৌমিক। ওই সময় আটক করা হয় জঙ্গি শফিউল ও স্থানীয় তরুণ জাহিদুল ইসলাম ওরফে তানিমকে। এর মধ্যে শফিউল ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার ডাংরি এলাকায় র্যাবের সঙ্গে গোলাগুলিতে নিহত হন।
ঘটনার তিন দিন পর ১০ জুলাই পাকুন্দিয়া থানার সে সময়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সামসুদ্দীন বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে কিশোরগঞ্জ মডেল থানায় একটি মামলা করেন। পুলিশ ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে আর ২৮ নভেম্বর এ মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়। এ মামলার তদন্ত শেষে মোট ২৪ জনকে আসামি করা হয়। তাদের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানকালে ১৯ জন মারা যায়। পাঁচজন দেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী।
কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ প্রথম আলোকে বলেন, শোলাকিয়া হামলার ঘটনাটি এখন আদালতে বিচারাধীন। পুলিশের পক্ষ থেকে ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। এ মামলায় দোষী ব্যক্তিদের যাতে সর্বোচ্চ শাস্তি সুনিশ্চিত হয়, সে কামনা করেন তাঁরা।