৩ মিনিট স্তব্ধ থাকল নেত্রকোনা শহর
আজ ৮ ডিসেম্বর, শুক্রবার। সকাল ১০টা ৪০ মিনিট থেকে ১০টা ৪৩ মিনিট পর্যন্ত নেত্রকোনা শহরের রাস্তায় চলেনি কোনো যানবাহন, হাঁটেননি কোনো পথচারী। তিন মিনিট স্তব্ধ ছিল পুরো শহর। ঘড়ির কাঁটায় ১০টা ৪০ বাজার সঙ্গে সঙ্গেই সবাই নিজেদের কাজ ফেলে রাস্তায় নেমে আসেন। সড়কের যানবাহনগুলো চলাচল থামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দোকানিরাও এ সময় নেমে আসেন রাস্তায়। তাঁরা শ্রদ্ধা জানান ১৮ বছর আগে নেত্রকোনা উদীচীতে বোমা হামলায় নিহত ব্যক্তিদের প্রতি।
২০০৫ সালের এই দিনে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী নেত্রকোনা সংসদ কার্যালয়ের সামনে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায় নিষিদ্ধ জঙ্গিসংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। হামলায় নিহত হন আটজন। নিহতদের স্মরণে প্রতিবছর ৮ ডিসেম্বর শহরের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন ‘নেত্রকোনা ট্র্যাজেডি দিবস’ পালন করে আসছে।
দিবসটি উপলক্ষে আজ সকাল নয়টায় শহরের অজহর রোড এলাকায় উদীচী কার্যালয়ের সামনে কালো পতাকা উত্তোলন ও কালো ব্যাজ ধারণ করা হয়। পরে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে উদীচী ট্র্যাজেডি স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। সেখান থেকে প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে শহরের প্রধান সড়কগুলো ঘুরে ছোট বাজার এলাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনের সড়কে সমাবেশ হয়। সেখানে গণসংগীতের ফাঁকে ফাঁকে বক্তব্য দেন সমবেত ব্যক্তিরা।
ট্র্যাজেডি দিবস পালন কমিটির আহ্বায়ক আলী আসগার খানের সভাপতিত্বে ও সদস্যসচিব অসিত ঘোষের সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য হাবিবা রহমান খান, সাবেক যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান, বীর মুক্তিযোদ্ধা সুব্রত ঘোষ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. শামছুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ভজন সরকার, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান তুহিন আক্তার, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি অর্পিতা খানম, মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তাহেজা বেগম, জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সভাপতি পূরবী কুণ্ডু, প্রাবন্ধিক স্বপন কুমার পাল, নারী প্রগতি সংঘের ব্যবস্থাপক মৃণাল চক্রবর্তী, প্রত্যাশা সাহিত্য গোষ্ঠীর সভাপতি দেবাশীষ সরকার প্রমুখ।
সমাবেশে সংসদ সদস্য হাবিবা রহমান খান বলেন, ‘দ্রুত বিচার ও বিস্ফোরক মামলার রায় কার্যকর হওয়ায় আমরা খুশি। তবে জঙ্গিবাদের মূল উৎপাটন করতে হলে আরও শিকড়ে যেতে হবে। স্থানীয় মদদদাতাদের খুঁজে বের করতে হবে। তা না হলে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস নির্মূল সম্ভব হবে না।’
‘৩ মিনিট স্তব্ধ নেত্রকোনা’ কর্মসূচি পালন শেষে সন্ত্রাস, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মানববন্ধন হয়। পরে শহীদদের কবর জিয়ারত, শ্মশানের স্মৃতিফলকে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং শহীদদের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা হয়।
উদীচী সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫ সালের ৯ ডিসেম্বর নেত্রকোনা হানাদারমুক্ত দিবস উপলক্ষে আগের দিন ৮ ডিসেম্বর সকালে উদীচী কার্যালয়ের সামনে চলছিল মহড়ার প্রস্তুতি। এ সময় আত্মঘাতী এক বোমা হামলায় প্রাণ হারান জেলা উদীচীর সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক খাজা হায়দার হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক সুদীপ্তা পাল শেলি, মোটরসাইকেল মেকানিক যাদব দাস, পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী রানী আক্তার, মাছ বিক্রেতা আফতাব উদ্দিন, শ্রমিক রইছ মিয়া, ভিক্ষুক জয়নাল, আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী আল বাকি মো. কাফিসহ আটজন। আহত হন অর্ধশতাধিক।
১৮ বছর পার হলেও এখনো সেই স্মৃতি তাড়া করে বেড়ায় নিহতদের স্বজনদের। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম খাজা হায়দার হোসেনকে হারিয়ে এখনো দিশাহারা তাঁর স্ত্রী শাহানাজ পারভিন। স্বামীর রেখে যাওয়া একচিলতে জায়গার ওপর একটি টিনের চালাঘরে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে থাকেন তিনি। আর শহরের নিউটাউন এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকে সুদীপ্তা পাল শেলির পরিবার। একমাত্র উপার্জনক্ষম মেয়েকে হারানোর পর কষ্টে দিন পার করছেন মা অরুণা রানী পাল।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এক আসামি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে
হামলার ঘটনায় পরদিন পুলিশ বাদী হয়ে নেত্রকোনা মডেল থানায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ও বিস্ফোরক আইনে পৃথক দুটি মামলা করে। এর মধ্যে বিস্ফোরক আইনে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালত ২০০৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আসামি জেএমবির কমান্ডার সালাউদ্দিন ওরফে সালেহীন ও শুরা সদস্য আসাদুজ্জামান চৌধুরী ওরফে পনিরের মৃত্যুদণ্ড দেন। ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সালাউদ্দিন, আসাদুজ্জামান ও ইউনুছ আলীকে মৃত্যুদণ্ড দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২। একই বছরের ২৩ মার্চ ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ একই রায় প্রদান করেন। মামলার অপর আসামি সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাই ও আতাউর রহমান সানির অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় তাঁদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া বাংলা ভাইয়ের স্ত্রী ফারজানাকে খালাস দেওয়া হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে আসাদুজ্জামান ওরফে পনিরের ২০২১ সালের ১৫ জুলাই রাতে গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। আর সালাউদ্দিন ওরফে সালেহীনকে ২০১৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে এক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। তিনি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।