বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগের বিভেদের মধ্যে দলীয় প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ তাঁর বড় ভাই আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর স্ত্রীর কবর জিয়ারত করেছেন। শুক্রবার জুমার নামাজের পর নগরের মুসলিম গোরস্তানে তিনি ভাবি শাহান আরা আবদুল্লাহর কবর জিয়ারত করেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে হাসানাত আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস উপস্থিত ছিলেন।
শাহান আরা আবদুল্লাহ বরিশাল সিটির বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর মা। তিনি ২০২০ সালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ভাবির কবর জিয়ারত এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে দলীয় প্রার্থীর পাশে দেখে এ ঘটনাকে চাচা-ভাতিজার মধ্যে চলা বিভেদের বরফ গলার আভাস বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের নেতারা।
বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবার দলীয় মনোনয়ন পাননি বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ। মনোনয়ন পেয়েছেন তাঁর ছোট চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত। এতে শুরু থেকেই সাদিক আবদুল্লাহর পক্ষে থাকা মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা দলীয় প্রার্থীর ব্যাপারে নির্লিপ্ত ছিলেন।
মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও দলীয় প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির অন্যতম সদস্য মীর আমিন উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা অবশ্যই ইতিবাচক মনে করি। মান-অভিমান ভুলে সবাই দলীয় প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহর পাশে শামিল হবেন, আমরা এটা প্রত্যাশা করি। এটা যত দ্রুত হবে, ততই দল ও সবার জন্য মঙ্গলজনক।’
বরিশাল সিটি নির্বাচনে এবার দলীয় মনোনয়ন পাননি বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ। মনোনয়ন পেয়েছেন তাঁর ছোট চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহ। এতে শুরু থেকেই সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারী জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা দলীয় প্রার্থীর ব্যাপারে নির্লিপ্ত ছিলেন। সেই নির্লিপ্ততা একপর্যায়ে বিভেদ-সংঘাতে রূপ নেয়। এমন পরিস্থিতিতে গত বুধবার কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে প্রধান করে ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেয় কেন্দ্র। ওই কমিটি গঠনকে দুই পক্ষ বিরোধ নিরসনে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করলেও বিভেদের বরফ গলার আভাস দেখা যায়নি। এর মধ্যে শুক্রবার দুপুরে বড় ভাইয়ের স্ত্রীর কবর জিয়ারত করতে যান খায়ের আবদুল্লাহ।
খায়ের আবদুল্লাহ শুক্রবার নগরের গোরস্তান রোড মসজিদে জুমার নামাজ পড়ে মুসল্লিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। পরে তিনি মুসলিম গোরস্তানে ভাবি শাহান আরা আবদুল্লাহ ও মান্নান দরবেশের কবর জিয়ারত করেন। এ সময় বরিশালের প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন (হিরণ), জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মহিউদ্দিন আহম্মেদসহ আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের রুহের মাগফিরাত কামনায় দোয়া–মোনাজাত করা হয়।
তালুকদার মো. ইউনুস শুক্রবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবুল খায়ের দলীয় প্রার্থী। আমাদের নেতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বলে দিয়েছেন খোকন (খায়ের) আমার ছোট ভাই। সে অনুযায়ী সবাইকে তাঁর পাশে থাকতে হবে, তাঁকে বিজয়ী করতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।’
ভাবির কবর জিয়ারত করতে দলীয় প্রার্থী তাঁকে ডেকেছিলেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে ডাকাডাকির কোনো ব্যাপার নেই। খায়ের আবদুল্লাহর সঙ্গে আমাদের ছোটবেলা থেকে সম্পর্ক। এখন তিনি দলীয় প্রার্থী।’
দলের নেতারা এখনো প্রার্থীর পক্ষে নামছেন না কেন, জানতে চাইলে তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, সবাই নামবেন, একটু ধৈর্য ধরেন। আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর আগেই আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বরিশালে আসবেন। যেহেতু তিনি সংসদ সদস্য, তাই বিধি অনুযায়ী সিটি এলাকায় তিনি সভা করতে পারবেন না। এ জন্য সিটি এলাকার বাইরে কোনো একটি জায়গায় তিনি নগর, জেলা ও ৩০টি ওয়ার্ডের নেতা-কর্মীদের নিয়ে বসবেন এবং নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনায় নির্দেশনা দেবেন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বরিশালের রাজনীতিতে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর প্রভাবের কারণে তাঁর ছেলে সাদিক আবদুল্লাহ গত নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। এরপর সাদিক আবদুল্লাহ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হলে মহানগর আওয়ামী লীগ থেকে প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণপন্থী নেতা-কর্মীরা ছিটকে পড়েন। নিজের লোকদের নিয়ে মহানগর ও ৩০টি ওয়ার্ড কমিটি গঠন করে সাদিক আবদুল্লাহ নিজের প্রভাববলয় তৈরি করেন বলে অভিযোগ আছে। বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক মন্ত্রিত্ব পেলেও সাদিক আবদুল্লাহর প্রভাবে দলে ছিলেন কোণঠাসা। ছিটকে পড়া প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণের সমর্থক নেতা-কর্মী ও পুরোনো নেতারা পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীকে ঘিরে আলাদা বলয় তৈরি করলেও তাঁরা এত দিন নীরব ছিলেন। খায়ের আবদুল্লাহ মনোনয়ন পাওয়ার পর তাঁরা নতুন করে উজ্জীবিত হয়ে তাঁর পক্ষে নেমেছেন।
দলের নেতাদের নির্লিপ্ততা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে দলটির জাতীয় কমিটির সদস্য গোলাম আব্বাস চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিটা বিষয়ই একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগোতে হয়। যাঁরা দলের নেতৃত্ব দেন, তাঁদের যথাযথ সম্মান, মর্যাদা নিশ্চিত না করা হলে সেটাও অবমাননাকর বিষয়ে পরিণত হয়। আমরা বলিনি দলীয় প্রার্থীর পক্ষে যাব না কিংবা আমাদের নেতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বলেননি, তিনি আসবেন না। আমি বারবারই বলেছি, তিনি বরিশালে যাবেন।’ তিনি বলেন, এ নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত যারা সৃষ্টি করছে, তারা একটি বিশেষ পক্ষ। তাদের মূল উদ্দেশ্য দলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা। তারা চাইছে, হাসানাত আবদুল্লাহকে বরিশালের রাজনীতি থেকে উৎখাত করবে, কিন্তু এটা অসম্ভব ব্যাপার।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, বরিশাল সিটি নির্বাচনে ১৯ থেকে ২১ মে পর্যন্ত মনোনয়ন বাছাইয়ের বিরুদ্ধে আপিল, ২২ থেকে ২৪ মে আপিল নিষ্পত্তি ও ২৫ মে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন। ২৬ মে প্রতীক বরাদ্দের পর আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু করতে পারবেন প্রার্থীরা। আগামী ১২ জুন ভোট গ্রহণ হবে।