উঠানে কবরের দিকে তাকিয়ে বাবাকে খোঁজে ৫ বছরের ইলমা

বারান্দাটি থেকে জাকিরের কবর দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে বাবার কবরের দিকে তাকিয়ে থাকে পাঁচ বছর বয়সী ইলমা। গত রোববার বিকেলে গাজীপুরের শ্রীপুরের কপাটিয়াপাড়া গ্রামেছবি: সাদিক মৃধা

সুনসান বাড়ির উঠান পেরোতেই দেখা হয় ছোট্ট ইলমার সঙ্গে; পুরো নাম রামিসা তাবাসসুম ইলমা। বাড়িটির বারান্দায় বসে গ্রিল ধরে উঠানের দিকেই তাকিয়ে আছে পাঁচ বছর বয়সী মেয়েটি। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘জাকির হোসেন তোমার কী হয়?’ মলিন মুখে জবাব দিল, ‘আমার বাবা।’ সঙ্গে সঙ্গে সতর্কবার্তায় জানাল, ‘আমার বাবার কথা দাদা-দাদুর কাছে বইলেন না। কান্না করবেন তাঁরা।’

কথোপকথনের আওয়াজ শুনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন এক বৃদ্ধ। এই প্রতিবেদকের পরিচয় জেনে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলেন। কৌতূহলে এগিয়ে এলেন প্রতিবেশীদের অনেকেই। এই বৃদ্ধের নাম জামাল উদ্দিন দয়াল। তাঁর একমাত্র ছেলে জাকির হোসেন রানা (৩৩) ছাত্র-জনতার এক দফা দাবির আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জাকিরের পরিবারের সদস্যরা বলেন, ৫ আগস্ট গাজীপুরের শ্রীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পল্লী বিদ্যুৎ মোড় এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন তিনি। ঘটনাস্থলে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ছিলেন কিছুক্ষণ। এরপর আরও চারজন গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিকে বহন করা একটি গাড়িতে তাঁকে তোলা হয়। সেখান থেকে তাঁদের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল। তবে পথেই তাঁর মৃত্যু হয়।

মা-বাবা, স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন জাকির। বসবাস করতেন শ্রীপুরের কপাটিয়াপাড়া গ্রামে। আর চাকরি করতেন বাড়ির অদূরে চকপাড়া মোড়ল মার্কেট এলাকার ঢাকা ফারইস্ট গার্মেন্টসে। জামাল উদ্দিনের সঙ্গে এসব কথোপকথনের সময় তাঁর কোলে এসে বসে নাতি ইলমা। আবার কথা হয় তার সঙ্গে। ইলমা বলে, ‘আমার বাবাকে ছাড়া ঘুমাই না; কিন্তু এখন আর আমার বাবা আসে না। মার সঙ্গে ঘুমাইতে হয়। বাবা অফিসে গেছে। এরপর আর ফিরা আসে নাই।’

জাকির হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

ছলছলে চোখে ইলমার এমন অনর্গল কথায় সেখানে উপস্থিত সবাই হুহু করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। নাতিকে জড়িয়ে ধরে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করেন দাদা জামাল উদ্দিন। ঘটনার বর্ণনায় তিনি বলেন, ৪ আগস্ট সব কারখানার মতো জাকিরদের কারখানাও বন্ধ হয়। ফলে জাকির বাড়িতেই ছিল। পরদিন ৫ আগস্ট দুপুরে জাকিরকে একজন ফোন দেন। ফোন পেয়ে বেলা পৌনে তিনটার দিকে জাকির বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। এরপর বিকেল সাড়ে চারটার দিকে খবর পান জাকির গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জামাল উদ্দিনকে বলেন, শ্রীপুরের মাওনা চৌরাস্তার উত্তরে পল্লী বিদ্যুৎ মোড়ে বিজিবির সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ চলছিল। ওই সময় সেখানে বিজিবির গুলিতে মারাত্মক আহত হন জাকির। এর কিছুক্ষণ পর ছেলের মৃত্যুর সংবাদ পান তাঁরা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জামাল উদ্দিনকে বলেন, শ্রীপুরের মাওনা চৌরাস্তার উত্তরে পল্লী বিদ্যুৎ মোড়ে বিজিবির সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ চলছিল। ওই সময় সেখানে বিজিবির গুলিতে মারাত্মক আহত হন জাকির। এর কিছুক্ষণ পর ছেলের মৃত্যুর সংবাদ পান তাঁরা।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের কিছুক্ষণ পর শ্রীপুরের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পল্লী বিদ্যুৎ মোড়ে উত্তেজিত ছাত্র-জনতার সঙ্গে বিজিবির সদস্যদের সংঘর্ষ হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে পাঁচজন নিহত হন। তাঁদের একজন জাকির হোসেন। বাকিরা হলেন কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার আসাদের ছেলে সিফাত উল্লাহ (২২), শ্রীপুর পৌরসভার দারগারচালা গ্রামের শুক্কুর আলীর ছেলে শরিফ আহমেদ (২০), ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার তাজুল ইসলামের ছেলে মো. কাওসার (২৮) ও নান্দাইল উপজেলার আবদুল হাইয়ের ছেলে জুয়েল মৃধা (৩০)।

জামাল উদ্দিন যখন ঘটনার বর্ণনা করছিলেন, তখন পাশে বসে আঁচলে মুখ ঢেকে ডুকরে কাঁদছিলেন জাকিরের মা জায়েদা আক্তার। তিনি বলছিলেন, ‘আমার বাবা বাইর হইয়া যাওয়ার সময় কিছু বইলা গেল না। একটা মাইয়া আর একটা পোলা আছিল আমার। অহন পোলাডাই নাই। অহন কেডা দেখব বাপমরা মাইয়াডারে। কী বুঝামো তারে?’

ছেলের কথা মনে করে আঁচলে মুখ ঢেকে ডুকরে কাঁদছিলেন জাকিরের মা জায়েদা আক্তার। গত রোববার তোলা
ছবি: সাদিক মৃধা

ছোট্ট ইলমাকে নিয়ে এখন দুশ্চিন্তা শেষ নেই পরিবারটির। বাবা হারানোর কষ্ট সহ্য করর মতো বয়স তার হয়নি। তবুও বাবার অভাব বোধে বারবার ভেঙে পড়ে সে। জাকির হোসেনের স্ত্রী মনি আক্তার বলেন, ‘মেয়ে জিজ্ঞেস করতাছে, “মা তোমরা যে সবাই বলতেছ আমার বাবা মারা গেছে। তাহলে কি আমি আর আমার বাবারে দেখতে পারমু না? আমি কি আমার বাবার সাথে ঘুমাইতে পারমু না?” এরপর তার কথা শুইনা আমরা যহন কান্নাকাটি শুরু করছি, তখন সে বলে, “মা আমি আর আমার বাবার কতা তোমরারে জিগাইতাম না। আমার ভুল হয়ে গেছে”—বলেই কান্না শুরু করে দিছে আমার মেয়ে। এখন সে চুপ করে থাকে। গোপনে কান্দে।’

জাকির হোসেনের দাফন হয়েছে বাড়িটির উঠানের কোনায় লিচুগাছের নিচে। এবার বোঝা গেল, বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ইলমা তার বাবার কবর দেখছিল। জাকিরের মৃত্যুর পর সে প্রায়ই বারান্দার গ্রিল ধরে বাবার কবরের দিকে নির্বাক চেয়ে থাকে বলে জানান স্বজনেরা।

বাড়িটির উঠানের কোনায় লিচুগাছের নিচে জাকির হোসেনকে দাফন করা হয়েছে। গত রোববার তোলা
ছবি: সাদিক মৃধা

ইলমা যেখানে দাঁড়িয়ে বাবাকে খুঁজে, সেখান থেকে জাকিরের কবরের দূরত্ব ১৫ ফুটের বেশি নয়। অথচ ইলমাকে ছেড়ে আজীবনের জন্য অসীম দূরত্বে চলে যেতে হয়েছে তাঁকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে এই কথাগুলো বলছিলেন জাকিরের প্রতিবেশী মাসুদ রানা। তিনি বলেন, জাকিরের মৃত্যুর পর পরিবারটি একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। পরিবারের দায়িত্ব ছিল জাকির হোসেনের ওপর। ছোট্ট শিশুটির দিকে তাকানো যায় না। একদিকে শোক, অন্যদিকে অনভ্যস্ত জীবনযাপন পদ্ধতির পীড়া বয়ে বেড়াতে হচ্ছে পরিবারটিকে।