পলো হাতে মাছ ধরতে দলে দলে শৌখিন শিকারিরা গোমতীতে, মাছ পেলেই হইহুল্লোড়

গতকাল সোমবার গোমতী নদীর পাড়ে পলো দিয়ে মাছ ধরার উৎসবের ছবি তোলেন প্রথম আলোর কুমিল্লার ফটোসাংবাদিক এম সাদেক। ছবি তোলার সময় তিনি অসুস্থ বোধ করেন। দ্রুত স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। ছবিটি তাঁর কর্মজীবনের শেষ দিনের ছবিছবি: এম সাদেক

মাঘ পেরিয়ে ফাগুনের শুরু। প্রকৃতিতে এখনো শীতের আবহ। এমন সময় দলে দলে কুমিল্লার গোমতী নদীর দিকে ছুটছিলেন কিছু শৌখিন মানুষ। তাঁদের সবার হাতে পলো। শখের বশেই তাঁরা নদীতে এসেছেন মাছ ধরতে। নদীতে নামার পর কারও পলোতে মাছ আটকালে চারদিকে হইহুল্লোড় পড়ছিল। আবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চেষ্টা করেও মাছ না পেয়ে শূন্য হাতেই কাউকে কাউকে ঘরে ফিরতে হয়েছে। এমন দৃশ্যই দেখা গেছে কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া গোমতী নদীতে।

শৌখিন মাছশিকারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবছর শীতের শেষ সময়ে গোমতী নদীর পানি কমে এলে শৌখিন মাছশিকারিরা দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন পলো দিয়ে মাছ ধরার ঐতিহ্য আর উৎসবে মিলিত হতে। গতকাল সোমবার এবং আগের দিন রোববার পাঁচ শতাধিক শৌখিন মাছশিকারি একসঙ্গে নেমে গোমতীতে মেতে ওঠেন পলো উৎসবে।

গতকাল সকালে কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার টিক্কারচর সেতুর নিচ থেকে শুরু হয় পলো উৎসব, শেষ হয় প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে একই উপজেলার বানাসুয়া এলাকায় গিয়ে। এর আগের দিন রোববার ভারত সীমান্তের জিরো পয়েন্ট কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার কটকবাজার এলাকা থেকে শুরু হয়ে টিক্কারচর এলাকায় গোমতী নদীর সেতু পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার এলাকায় চলে পলো দিয়ে মাছ শিকার। পলো ছাড়াও অনেক শৌখিন মাছশিকারির কাছে ছিল ঝাঁকিজাল ও ঠেলাজাল। দুই দিনই অনেক শিকারির পলোতে ধরা পড়েছে বড় বড় রুই, কাতলা, বোয়াল, গজার, আইড়, মৃগেলসহ নানা ধরনের মাছ। এ ছাড়া হাতে ও জালে ধরা পড়ছে ট্যাংরা, বইচা, বাইম, কাচকিসহ নানান ধরনের ছোট মাছ। কারও পলো বা জালে বড় মাছ ধরা পড়লেই হইহুল্লোড়ে মেতে ওঠেন শৌখিন মাছশিকারিরা।

নদীর এক দিক থেকে সারিবদ্ধ হয়ে মাছ ধরেন শিকারিরা। ছবি: এম সাদেক ছবি-৩: কেউ মাছ ধরছেন, কেউ রাখছেন
ছবি: এম সাদেক

শৌখিন মাছশিকারিদের প্রতিবছর পলো উৎসবে একসঙ্গে যুক্ত করেন কুমিল্লা নগরের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবদুর রহিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শীতের শেষে নদীর পানি কমে এলেই আমরা এভাবে পলো উৎসবে মিলিত হই। আমরা যাঁরা প্রতিবছর একত্র হয়ে মাছ ধরতে আসি, তাঁদের মধ্যে কয়েক দিন আগে থেকেই মুঠোফোনে যোগাযোগ হয়। প্রতিটি এলাকার একজন দিনক্ষণ জানলেই তাঁর এলাকার অপর শৌখিন শিকারিদের জানিয়ে দেন। এবার আমরা দুই দিনের পলো উৎসবে মেতেছি। প্রায় পাঁচ শ মানুষ এতে অংশ নেন। কুমিল্লা নগর ছাড়াও কুমিল্লা সদর দক্ষিণ, চৌদ্দগ্রাম, লালমাই, নাঙ্গলকোট, লাকসাম, মনোহরগঞ্জ ও বরুড়া উপজেলার মানুষ এতে বেশি অংশ নিয়েছেন।’

আবদুর রহিম আরও বলেন, মানুষ শখে এখানে আসেন। কারণ, নদীতে আগের মতো মাছ নেই। এ ছাড়া নদীর নাব্যতাও হারিয়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে পানি একেবারেই কমে যায়, ভারতের উজান থেকে পানি কম আসে। নদীতে পানি না থাকলে মাছও থাকে না।
কুমিল্লার ইতিহাস–গবেষক আহসানুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, নদী, বিলসহ উন্মুক্ত জলাশয়ে এভাবে পলো দিয়ে মাছ ধরা কুমিল্লা অঞ্চলের শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্য। শুধু গোমতী নদী নয়, ডাকাতিয়াসহ কুমিল্লার অন্যান্য নদ-নদীতেও এভাবে দল বেঁধে পলো উৎসবে মেতে ওঠেন শৌখিন মৎস্যশিকারিরা। একসময় এমন পলো উৎসব ঘিরে আত্মীয়স্বজনেরা বেড়াতে আসতেন। প্রচুর মাছও পাওয়া যেত। কিন্তু এখন আর আগের মতো দেশীয় মাছ পাওয়া যায় না। এরপরও একদল শৌখিন মানুষ শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।

কিছু স্থানে জমে থাকা কচুরিপানার নিচে মাছ ধরার চেষ্টা
ছবি: এম সাদেক

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কুমিল্লার নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয়ে এখন আর আগের মতো দেশীয় মাছ পাওয়া যায় না। অবাধে ছোট মাছ আহরণ, ডিমওয়ালা মাছ নিধন, পুকুর-ডোবায় বিষ ঢেলে মাছ শিকার, কৃষিজমিতে কীটনাশক প্রয়োগসহ নানা কারণে দিন দিন বিভিন্ন জাতের দেশি মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে। সে কারণে শৌখিন মৎস্যশিকারিদেরও জাল বা পলো হাতে এখন আর আগের মতো সেভাবে দেখা যায় না নদী ও খালে। এরপরও কিছু মানুষ প্রতিবছর এভাবে গোমতীতে ছুটে আসেন শখের বশে।

কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার হাজতখোলা এলাকার বাসিন্দা রাসেল আহমেদ গোমতীতে পলো দিয়ে দুই কেজি ওজনের একটি বোয়াল মাছ পেয়েছেন। রাসেল প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেড় দশকের বেশি সময় ধরে প্রায় প্রতিবছরই আমরা এভাবে পলো দিয়ে বছরের অন্তত এক দিন হলেও মাছ ধরতে আসি গোমতীতে। এখানে কেউই পেশাদার জেলে নন। যা পান, এসব মাছ কেউ বিক্রিও করেন না। মূলত শখের কারণেই এখানে আসেন মানুষজন। বেশির ভাগ মানুষেরই খরচ আরও বেশি হয়।’

পলোতে করে মাছ নিয়ে ঘরে ফেরা
ছবি: এম সাদেক

গত বছর বন্যা হওয়ায় এ বছর মাছ বেশি পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে আসা নাজমুল হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথম দিন পেয়েছি গজার ও বাইম মাছ আর দ্বিতীয় দিন পেয়েছি কাতলা মাছ। আমরা চার ভাই এসেছি মাছ ধরতে। এক ভাই বোয়াল মাছও পেয়েছেন।’

কুমিল্লা আদর্শ সদরের টিক্কারচর এলাকার সত্তরোর্ধ্ব কৃষক আবদুর রশিদ বলেন, দুই দশক আগেও এ অঞ্চলে আনন্দ-উল্লাসের মাধ্যমে হইহুল্লোড় করে পলো দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ধরতেন তরুণ-যুবক-বৃদ্ধসহ নানা বয়সের মানুষ। এ সুযোগে ছোট ছেলেমেয়েসহ স্থানীয় মৎস্যজীবীরাও নেমে পড়তেন মাছ ধরতে। নদী ও খালে হাঁটুপানি, কোথাও কোমর বা গলাপানি থাকত। মাইলের পর মাইল নদী-খালে হাজার হাজার মানুষ পলো নিয়ে নামতেন মাছ শিকারে। এখন আর ওই সব দৃশ্য দেখা যায় না। তবে কিছু লোক এখনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।