‘ই হাড় ফাটা শীতোত তোমার কম্বল কোনো মোর জান বাঁচাইল’

কম্বল পেয়ে খুশি তারাগঞ্জের শীর্তাতরা। আজ মঙ্গলবার রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার জগদীশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠেছবি: প্রথম আলো

৭০ বছর বয়সী আম্বিয়া বেগমের স্বামী মারা গেছেন ১৫ বছর আগে। এবাড়ি–ওবাড়ি খুঁজে পেটে ভাত জোটে তাঁর। পুরোনো পাতলা একটি শাড়ি পরে কুয়াশার মধ্যে কম্বল নিতে এসে কাঁপছিলেন তিনি। পুব আকাশে সূর্য উঁকি দিতেই পৌষের মিষ্টি রোদ তাপাচ্ছিলেন। তাঁর গায়ে কম্বল মুড়িয়ে দিতেই সেটি শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন। পরক্ষণেই মুখ তুলে হাসি দিয়ে আম্বিয়া বলেন, ‘এবার খুব ঠান্ডা। রাইতোত বৃষ্টির মতোন শীত পড়ে। অ্যানা কম্বল না থাকায় শান্তিতে ঘুমবার পাড়ো নাই। খড়কুটার আগুন পোহে রাইত জাগছুন। এই হাড় ফাটা শীতোত তোমার কম্বল কোনো মোর জান বাঁচাইল।’

আম্বিয়া বেগমের বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম সরকারপাড়ায়। ১৫ বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর অন্যের বাড়িতে কাজ করে ভাত–কাপড়ের ব্যবস্থা করলেও বয়সের ভারে ন্যুব্জ আম্বিয়ার এখন বেঁচে থাকার অবলম্বন এবাড়ি–ওবাড়ি খুঁজে খাওয়া। শীতের কাপড় কেনা তাঁর পক্ষে দুষ্কর। আজ মঙ্গলবার সকালে জগদীশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে কম্বল নিতে এসেছিলেন তিনি। তাঁর মতো ২০০ মানুষকে প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে সেখানে কম্বল দেওয়া হয়।

আম্বিয়ার মতো শীতের কষ্টে থাকা বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা মানুষদের চোখেমুখে কম্বল পেয়ে হাসির ঝিলিক ফুটেছে। সকালের ঘন কুয়াশা ও শীত মাড়িয়ে কেউ লাঠিতে ভর করে, কেউ হেঁটে, কেউ হুইলচেয়ারে চেপে এসেছিলেন কম্বল নিতে। শীতার্তদের মাঠে সারি করে বসিয়ে সকাল ১০টায় কম্বল বিতরণ শুরু হয়। কম্বল হাতে পেয়ে কারও চোখের কোণে আনন্দের পানি, কারও মুখে রাতভর আরামে ঘুমানোর আগাম খুশি ফুটে ওঠে।

প্রথম আলো ট্রাস্টের পক্ষ থেকে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার জগদীশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে ২০০ জন শীতার্ত মানুষকে কম্বল দেওয়া হয় আজ মঙ্গলবার
ছবি: প্রথম আলো

কম্বল নিতে এসেছিলেন ছুট হাজীপাড়া গ্রামের স্বপ্না বেগম (৪৫)। সাত বছর আগে তাঁর স্বামী মারা গেছেন। সন্তান নেই। স্বপ্না বলেন, ‘যার কিছু নেই, তার আল্লাহ আছে। এবার অঘ্রান মাসের শেষ থেকে খুব শীত। একটা কম্বল খুব দরকার ছিল, কিন্তু কেনার সামর্থ্য ছিল না। আল্লাহ আমার মনের কথা শুনছে। রাতে স্লিপ পাইছি, সকালে কম্বল পাইলাম। কম্বলটা গায়ে দিয়ে এ বছর শীত পার করব।’

গায়ে মোড়ানো কম্বল এক হাতে জড়িয়ে অন্য হাতে লাঠিতে ভর করে বাড়ি ফিরছিলেন ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের ৭৫ বছরের বৃদ্ধা ফুলবী বেগম। মুখভরা হাসি নিয়ে ভাঙা কণ্ঠে ফুলবী বেগম বলেন, ‘যে জাড় শুরু হইছে, রাইতোত কাঁপুনি ওঠে। মনে হয়, এই জানটা বের হয়া গেল, বাঁচপের নেও। বাবারা মোক ডাকি আনি কম্বল দেইল। আল্লাহ রহমত করলেও আরও একটা শীত তোমার কম্বল কোনা গায়োত দিয়া বাঁচির পাইম।’

কম্বল বিতরণের আগে গ্রামে ঘুরে দুস্থ অসহায় শীতার্ত মানুষের মধ্যে স্লিপ বিতরণ করেন তারাগঞ্জ বন্ধুসভার সদস্যরা। আজ সকাল ১০টায় জগদীশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে শীতার্তদের হাতে কম্বল তুলেন দেন তাঁরা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বন্ধুসভার আহ্বায়ক মামুন সরকার, সদস্য ইসরাত জাহান, নাঈম ইসলাম, সায়েম ইসলাম, রিফাত সরকার, রিয়াদ সরকার, আসাদুজ্জামান ও প্রথম আলোর তারাগঞ্জ প্রতিনিধি রহিদুল মিয়া।

ফকিরপাড়া গ্রামের মোনা মিয়ার এক পা নেই। তিনি এসেছিলেন লাঠিতে ভর করে। কম্বল পেয়ে মোনা মিয়া বলেন, ‘তোমার কম্বলকোনা কামোত দিবে। একনা গায়োত দিয়া আরামে থাকির পামো। আল্লাহ তোমার ভালো করবে।’

পোদ্দারপাড়া গ্রামের প্রতিবন্ধী রওশন আরা বলেন, ‘মেম্বার-চেয়ারম্যানের কাছোত একনা কম্বলের জন্য গেছনু, কায়ও মোর কথা শোনে নাই। ছাওয়ারা মোর বাড়িত যায়া স্লিপ দিছে, এ্যালা কম্বল পানু। এই শীতকোনা ভালোভাবে পার করা যাইবে।’